অক্টোবরের শেষে আমি আরেকবার পশ্চিম পাকিস্তানে যাই। এবার ইসলামাবাদে। ইসলামাবাদে কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। ছিলাম রাওয়ালপিন্ডিতে ইস্ট পাকিস্তান হাউজে। সেখানে একদিন প্রফেসর গোলাম ওয়াহেদ চৌধুরীর সাথে দেখা। তিনি এককালে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী সভার সদস্য ছিলেন এবং কিছুকাল ইয়াহিয়া খানের এডভাইজারও ছিলেন। তিনিও ইস্ট পাকিস্তান হাউজে থাকতেন। প্রফেসর চৌধুরী আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আপনার সাথে প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ হয়েছে কি? তিনি হয়তো আপনার মতো ব্যক্তির মুখে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা শুনতে পেলে উপকৃত হবেন। আমি বললাম আপনি যদি ব্যবস্থা করতে পারেন আমি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করতে পারি। তিনি এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন। পরদিন সরকারী গাড়ী এসে আমাকে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে নিয়ে যায়। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আর কেউ ছিলেন না। মনে হলো তিনি আমার সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে কথা বলতে চান। আমি তাঁকে প্রথমেই বললাম, আমি একজন সাধারণ নাগরিক। আপনি অভয় দিলেই আমি খোলাখুলি কথা বলতে পারি। প্রেসিডেন্ট বললেন, আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই, আপনি মন খুলে কথা বলুন। আমি তাঁকে বলি যে আপনারা পাকিস্তান রক্ষার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আর্মি পূর্ব পাকিস্তানে কাউকে বিশ্বাস করে না। সেজন্য এখনো যারা পাবিস্তান আদর্শে বিশ্বাসী তারা ক্রমশঃ হতাশ হয়ে পড়ছে। ২৫ শে মার্চ আর্মি যে ক্রাকডাউন করে তার মধ্যে ঢাকা ইউনিভার্সিটির উপর হামলা করে কয়েকজন শিক্ষক হত্যার ফলে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে সেটা কি আপনি জানেন? যাঁরা নিহত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে কেউ প্রকাশ্যভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন বলে আমার জানা নেই। তাছাড়া আপনি নিজে দু’বার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। একবার ২৬শে মার্চ এবং দ্বিতীয়বার জুন মাসে। আমি অতি দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে দু’বারের বক্তৃতায়ই পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত অধিবাসীর দেশ প্রেমের উপর কটাক্ষ করা হয়েছিলো। পূর্ব  পাকিস্তানে এখনো যে লক্ষ লক্ষ লোক পাকিস্তানে বিশ্বাস করে সে কথা আপনার বক্তৃতায় উল্লেখ ছিলো না। তাদের সহযোগিতা আপনি কামনা করেননি; ঢালাওভাবে আওয়ামী লীগের নিন্দা করেছেন এমন ভাষায় যাতে অনেকের ধারণা হতে পারে যে পূর্ব পাকিস্তানবাসী সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক।

ইয়াহিয়া খান স্বীকার করলেন যে তাঁর ভুল হয়েছে। তাঁর অফিসাররা তাঁকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারেননি। তিনি বললেন পরবর্তী সময়ে আমি যখন বক্তৃতা করবো, আশা করি, আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।

বলাবাহুল্য যে এই সাহায্যের প্রয়োজন আর হয়নি। কারণ তার আগে ১৬ই ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের পতন ঘটে। তবে আমি আমার কথাগুলি প্রেসিডেন্টকে বলতে পারায় স্বস্তি অনুভব করেছিলাম। কারণ আমি আগাগোড়া লক্ষ্য করছিলাম যে ২৫শে মার্চ যেমন তেমনি পরেও নির্বুদ্ধিতার কারণে আর্মি সাধারণ লোকজনকে পাকিস্তান বিরোধী করে তুলছিলো।

অক্টোবর থেকে নানা গুজব ছড়াতে থাকে। কলকাতাস্থিত স্বাধীন বাঙলা সরকারের প্রচারণাও আরো তীব্র হয়ে উঠে। ঐ প্রচারণা যারা পরিচালনা করতেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন আখতার মুকুল ও সৈয়দ আলী আহসান। আখতার মুকুল ‘চরমপত্র’ বলে একটা প্রোগ্রাম করতেন যাতে অন্যান্য কথার মধ্যে যারা তখনো বিদ্রোহে যোগদান করেনি তাদের বিরুদ্ধে হুমকি দেয়া হতো। আলী আহসান যেহেতু দাবী করতো সে পীর বংশের সন্তান, সে নেমেছিলো ধমীঁয় প্রচারণায়। কোরানের আয়াত পড়ে ব্যাখ্যা করে বলতো যে ইয়াহিয়া খানের সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করা জেহাদের শামিল এবং পূর্ব পাকিস্তানবাসী প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। আখতার মুকুলের চরমপত্রে যে সমস্ত ব্যক্তির প্রাণদন্ডের হুমকি থাকতো তাদেঁর মধ্যে থাকতেন গভর্নর আব্দুল মালেক, সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, ডক্টর হাসান জামান এবং আরো অনেকে। শুনেছি দু’একবার আমার নামও বলা হয়েছে। তবে এটা আমার নিজের কানে শোনা কথা নয়।


একদিন রাত্রে নয়টা বা সাড়ে নয়টায় ফোন এলো। আমিই ধরেছিলাম। আমার গলা শুনে অপর প্রান্ত থেকে এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন ‘আপনি তা হলে বেঁচে আছেন? আমি ময়মনিসংহ থেকে বলছি। আমরা এইমাত্র কলকাতার স্বাধীন বাংলা বেতারে শুনলাম আপনার প্রাণনাশ করা হয়েছে’। এই ভদ্রলোক কোন দলের ছিলেন জানি না তবে তাঁর গলার স্বরে মনে হয়েছিলো যে তিনি আমার শুভাকাঙক্ষী কোন ব্যক্তি।

প্রদেশের সর্বত্র যখন বোমাবাজি এবং লুটতরাজ হচ্ছে তখন একদিন কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক খোন্দকার মোকাররম হোসেন ফোন করে জানালেন যে, তাঁর ডিপার্টমেন্টে বারুদ জাতীয় কিছু বিস্ফোরক জমা রয়েছে। তিনি ভয় পাচ্ছেন যে গেরিলারা এগুলো চুরি করে নিয়ে ব্যবহার করবে। আর্মি যেনো এগুলো সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করে। তাঁর অনুরোধ আর্মিকে জানিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরক দ্রব্যগুলি কার্জন হল এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। প্রফেসর মোকাররম হোসেন ভয় পাচ্ছিলেন যে বিষ্ফোরক চুরি হয়ে গেলে তিনি নিজে ফ্যাসাদে পড়বেন।

নভেম্বরে একদিন গভর্নর মালেকের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি বললেন যে করাচীর কোন শাহ সাহেব নাকি বলেছেন যে পাকিস্তান টিকে থাকবে। ডক্টর মালেক খুব ধর্মভীরু ছিলেন। শাহ সাহেবের এই ভবিষ্যৎ বাণীটি আক্ষরিক অর্থেই সত্য বলে ধরে নিয়েছিলেন। পাকিস্তান অবশ্যই টিকে যায়, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান রক্ষা পায়নি। ডক্টর মালেক আরো জানালেন যে যাদের নিয়ে কোলকাতায় প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছে তাঁরা নাকি দু’দলে বিভক্ত। এক দল চাচ্ছিলেন ছ’দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সঙ্গে বোঝাপড়া করে গৃহযুদ্ধ বন্ধ করতে। এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। অপরদলের প্রধান ছিলেন তাজউদ্দিন। এরা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। ডক্টর মালেক বললেন যে এ সমস্যা নিয়ে কোলকাতায় বিতর্ক চলছে এবং শিগগিরই ভোটাভুটি করে এর মীমাংসা হবে। পরে শুনেছি যে খন্দকার মোশতাকের দল নাকি এক ভোটে হেরে যায়। তবে আমার বিশ্বাস যে প্রবাসী সরকারের পক্ষে স্বাধীনভাবে কোন কিছু করার ক্ষমতা ছিলো না। ইন্দিরা সরকারের নির্দেশেই তারা পরিচালিত হতেন। সুতরাং ইচ্ছা করলেই গৃহযুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তাদের হতো কিনা, সন্দেহ।

একদিকে যেমন স্বাধীন বাঙলা থেকে নানা কথা প্রচার করা হতো তেমনি অন্যদিকে ইন্ডিয়ার কমান্ডার ইন চিফ মানেক শ’র নামে উর্দু, পাঞ্জাবী এবং পশতু ভাষায় পাকিস্তান আর্মির উদ্দেশ্যে রোজই বক্তৃতা প্রচারিত হতো, কোন জায়গায় লিফলেট ছড়ানো হতো। বলা হতো যে পাকিস্তান আর্মির যুদ্ধে জয়লাভ করার কোন সম্ভাবনাই নেই; প্রাণ রক্ষা করতে হলে সৈন্যরা যেন অবিলম্বে অস্ত্র ত্যাগ করে এবং ইন্ডিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করে। তবে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এ রকম আত্মসমর্পণের কোনো খবরই আসেনি।

যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন পাকিস্তান আর্মি অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়েছিল, প্রশাসনেও তারা কোন দক্ষতা দেখাতে পারেনি। এদের চোখের সামনে বহুলোক মার্চ থেকে শুরু করে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন পথে ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছিল। কেউ কেউ আর্মির সহযোগিতায় ইংল্যান্ড আমেরিকা পর্যন্ত গেছে। একদিন শুনে অবাক হলাম যে ইসলামী ইতিহাসের অধ্যাপক এ বি এম হাবিবুল্লাহ যাঁকে টিক্কা খান বরখাস্ত করেছিলেন, করাচী হয়ে প্রথমে আফগানিস্তানে যান এবং সেখান থেকে লন্ডনে উপস্থিত হন। পশ্চিম পাকিস্তানে আটক বাঙালী অফিসার যারা বিদ্রোহে যোগদান করতে চান তারাও আফগানিস্তান পালিয়ে যেতেন এবং সেখান থেকে বিমানযোগে ইন্ডিয়ায় চলে আসতেন। একদল মুনাফা লোভী লোক মালপত্রের মধ্যে এদের লুকিয়ে সীমান্ত পার করে দিতো। এটা একটা বিরাট ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছিল।

নভেম্বরের শেষ দিকে অবস্থা আরো সংকটময় হয়ে ওঠে। ভারতীয় অনুপ্রবেশের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। শোনা যায় যে, কোন তারিখে ইন্ডিয়ান আর্মি ঢাকা দখল করবে সেটাও নাকি স্থির হয়ে গেছে।

উপায়ন্তর না দেখে তেসরা ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান ভারতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এটাও ছিলো তার একটি ভুল পদক্ষেপ। কারণ এতদিন ইন্ডিয়া পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করলেও সে যে প্রকাশ্যে পূর্ব পাকিস্তান দখলের চেষ্টা করছে, সে কথা স্বীকার করতো না। এবার আর  সে বাধা রইলো না। ইন্ডিয়ান আর্মি পশ্চিম পাকিস্তানেও আক্রমণ করতে শুরু করে। ব্যাপারটা তখন জাতিসংঘে পেশ করা হয়। সাধারণ পরিষদে ভোটাধিক্যে যুদ্ধ বন্ধ করার আবেদন জানানো হয় এবং নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বিরতির একটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়।  রাশিয়া এই প্রস্তাব বানচাল করে।

ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর থেকে ঢাকার উপর বিমান আক্রমণ শুরু হয়। দশ কিংবা এগারই ডিসেম্বর একদিনে যখন একদিনে এগারটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত হয় তখন হঠাৎ ঢাকার আকাশ-বাতাস পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। এই আকস্মিক বিজয়ে পাকিস্তানের প্রতি জনসাধারণের আস্থা আবার ফিরে আসে। কিন্তু এটা ছিলো ক্ষণিকের ব্যাপার। এরপর ভারতীয় আক্রমণে পূর্ব পাকিস্তানে যে কয়টি বিমান ছিলো তা ধ্বংস হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তান আরো অরক্ষিত হয়ে পড়ে, কারণ বিমানের সহযোগিত। না পেলে আধুনিককালে স্থল বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। তবু যে রহস্য আমরা কখনো বুঝতে পারিনি তা হলো পাকিস্তান আর্মি কেনো কোলকাতার তার উপর হামলা করলো না। আমি আগেই বলেছি যে জেনারেল নিয়াজীর স্ট্রাটেজি বুঝবার সাধ্য আমাদের ছিলো না। কোন সেক্টরেই তিনি আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। অথচ আর্মি অফিসাররা বলে বেড়াতেন যে সাহসে ও বীর্যে একজন পাকিস্তান সেনা দশ জন ইন্ডিয়ান সৈনিকের সমান। এই আষ্ফালনের কোনো পরীক্ষাই হয়নি।

১৩ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় ইন্ডিয়ান ছত্রী বাহিনী অবতরণ করবে বা করছে এরকম গুজব ছড়ায়। এতে আতঙ্ক আরো বেড়ে যায়। ১৩ এবং ১৪ই ডিসেম্বর ভাইস চান্সেলরের বাসার উপরেও বিমান আক্রমণ হয়। কয়েকটা   আমাদের বাগানে এবং দালানের দু’এক জায়গায় লাগে। নিষ্প্রদীপ মহড়ার জন্য তখন বাসার দরজা-জানালার কাঁচে কালো কাগজ এঁটে দেওয়া হয়েছিল। সন্ধ্যার পর অধিকাংশ বাতি নিভিয়ে রাখা হতো। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, এই বাসাটাও একটি সামরিক টার্গেটে পরিণত হয়েছে। তা ছাড়া মহসিন হল অঞ্চলেও একদিন বোমা পড়ে। কারণ একটি গুজব ছড়িয়েছিলো যে পাকিস্তান আর্মি কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়েছে।


১৪ই ডিসেম্বর

১৪ তারিখ রাত্রে বাসার উপর বিমান আক্রমণের পর আমি স্থির করি যে এখানে থাকা আর নিরাপদ নয়। কিন্তু এখান থেকে বেরুনোও ছিলো বিপদজনক, সারা শহরে তখন কারফিউ। আমি একজন আর্মি জওয়ানকে ডেকে কারফিউ-এর মধ্যে আমাদের পুরানো বাসা ১০৯ নম্বর নাজিমুদ্দিন রোডে পৌছে দিতে বললাম। সে রাজী হলে কাপড়ের দু’টো সুটকেস নিয়ে আমরা এ বাসায় ফিরে আসি। সব মালপত্র পড়ে থাকে ভাইস চান্সেলর ভবনে। এর অধিকাংশ আর পরে উদ্ধার করা সন্তব হয়নি। আর একটা ঘটনা বোধ হয় উল্লেখ করা দরকার। নভেম্বরের শেষ দিকে পাকিস্তান আর্মি কতটা মনোবল হারিয়ে ফেলেছিল তার প্রমাণ পেলাম যখন শুনলাম যে রাও ফরমান আলী গোপনে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব ইন্ডিয়াকে দিয়েছে। তাঁর প্রস্তাবের শর্ত কি ছিলো, জানি না। কিন্তু এ গুজব একেবারে ভিত্তিহীন ছিলো না বলে আমার বিশ্বাস। জেনারেল নিয়াজী নাকি চেয়েছিলেন শেষ অবধি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। দরকার হলে আর্মি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আশ্রয় নিতো কিন্তু এমন কিছুই হয় নাই। তাছাড়া গভর্নর মালেকও কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েন। তাঁর সরকারের পক্ষ থেকেও আত্মসমর্পনের কথা ওঠে। কিন্তু মন্ত্রী সভার সব সদস্য এতে সম্মত হননি। ১৪ তারিখে গভর্নর হাউজে মন্ত্রী সভার বেঠক হবার কথা ছিলো। এই সভয়ই স্থির হতো যে সরকার আত্মসমর্পণ করবে না যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। কিন্তু এই মিটিং হতে পারেনি। তার কারণ মিটিং-এর খবর কোন গুপ্তচর দিল্লীতে পৌছায়। তার মানে করাচীতেও গুপ্তচর বৃত্তিতে কিছু লোক নিযুক্ত ছিলো। মিটিং-এর ঠিক পূর্ব মুহুর্তে সভা কক্ষের উপর বোমা হামলা হয়। ডক্টর মালেক এবং মন্ত্রীরা কোন রূপে বেসমেন্টে আশ্রয় নিয়ে প্রাণে রক্ষা পান।

দেশের ভিতরে গুপ্তচর বৃত্তির এটাই একমাত্র প্রমাণ নয়। যে সমস্ত কান্ড হচ্ছিলো  তাতে সন্দেহের কারণ ছিলো যে এ অঞ্চলে বেসামরিক এবং সামরিক সব খবর নিয়মিতভাবে ইন্ডিয়াতে পৌছে দেওয়া হচ্ছে। কারা এ গুপ্তচর বৃত্তিতে লিপ্ত হয়েছিলো জানি না। তবে কে বিশ্বাসযোগ্য এবং কে বিশ্বাসযোগ্য নয় তা স্থির করা রীতিমতো মুশকিল হয়েপড়ে। নভেম্বরের আগে বা বোধ হয় সেই মাসেই কুর্মিটোলায়র ক্যান্টনমেন্ট সম্পর্কে এক গুজব আমাদের কানে আসে। শুনলাম ক্যান্টনমেন্ট মসজিদের ইমাম গুপ্তচর। সে ভালো কেরাত করে কোরআন শরীফ পড়তে পারতো। কিন্তু প্রমাণিত হয় সে আসলে একজন শিখ, গুপ্তচর বৃত্তির জন্যই এসব শিখেছিলো। ঠিক তেমনি পূর্ব পাকিস্তানের সেক্রেটারিয়েট এবং অন্যান্য অফিস সম্পর্কে অনেক খবর রটতে থাকে। এ রকম একটি খবরের ভিত্তিতে একবার আর্মি ইউনিভার্সিটির কয়েকজন শিক্ষককে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আমি মহা মুশকিলে পড়ি। কারণ এটা নিষ্চত ছিলো যে বিদ্রোহী দল এজন্য ভাইস চান্সেলরকে দোষারোপ করবে। তারপর অবশ্য আমার অনুরোধে এঁদের সবাইকে একজন একজন করে ছেড়ে দেয়। এদের মধ্যে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের আহসানুল হক ও রশিদুল হাসান ছিলো। খালাস করার সময় আর্মি নাকি এদের শিখিয়ে দিয়েছিলো যে আপনারা প্রথমেই যেয়ে ভাইস চান্সেলরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।

১৪ই ডিসেম্বরের আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন। সেদিন অফিসে বসা মাত্র খবর এলো যে ঐ দিন ভোর রাত্রে নাকি একদল সশস্ত্র ব্যক্তি ইউনিভার্সিটির কয়েকজন শিক্ষককে ধরে নিয়ে গেছে। যারা এসেছিলো তারা নাকি আর্মির লোক নয় কিন্তু এরা কারা সে রহস্য আজও উদঘাটিত হয় নাই। ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ছাড়াও আরো কিছু ব্যক্তিকে পাকড়াও করে এই দল নিয়ে যায় এবং ১৬ই ডিসেম্বরের পর লাশ মীরপুরের আশেপাশে পাওয়া যায়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন বাংলার মুনীর চৌধুরী,ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের রশিদুল হাসান, ইতিহাসের গিয়াসউদ্দিন আবুল খায়ের এবং সন্তোষ ভট্টাচার্য। আরো ছিলেন ইউনিভার্সিটির সহকারী মেডিক্যাল অফিসার ডাক্তার মুর্তজা।

ডাঃ মুর্তজা পিকিং পন্থী বামপন্থী দলের সমর্থক ছিলেন এবং বিচ্ছিন্নতার আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন না। এই কারণে এদের মৃত্যূ রহস্য আরো ঘনীভূত হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া এ কথাও মনে রাখা দরকার যে এঁদের ব্যক্তিগত মতামত যাই হয়ে থাকুক,প্রকাশ্যভাবে এরা কেউ গেরিলা যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। অবশ্য এ কথা উল্লেখ করা দরকার যে তখন শিক্ষক যারা কোন  রকমে ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে প্রায়ই কোলকাতা থেকে নানা হুমকি দেওয়া হতো। ১৬ তারিখে যখন পূর্ব পাকিস্তনের পতন ঘটে তখনো আমরা কেউ জানতাম না এ লোকগুলোর কি হয়েছে। এবং আজ পর্যন্ত আর্মি এবং রাজাকারদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ শোনা গেলেও এদের মৃত্যূ রহস্য সন্দেহাতীতভাবে উদঘাটিত হয় নাই। যখন পাকিস্তান আর্মি আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তার পূর্বক্ষণে তাদের বা তাদের সমর্থকদের এ রকম কান্ড ঘটাবার সাহস না থাকারই কথা।

১৪ই ডিসেম্বর যখন চারদিকে আতঙ্ক এবং যে কোন মুহুর্তে পাকিস্তান সরকারের পতন ঘটবে বলে শোনা যাচ্ছে তখন রাত্রে খুলনা থেকে একজন আমাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে ঢাকার অবস্থা কেমন? আমি যখন বললাম যে এখানের অবস্থা ভাল নয়, সে জানালো যে খুলনার দিকে ইন্ডিয়ান আর্মি প্রবেশ করতে পারেনি। পাকিস্তান আর্মি স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় ইন্ডিয়ানদের বাঁধা দিয়ে যাচ্ছে। বস্তূত ১৬ই ডিসেম্বর যখন জেনারেল নিয়াজী জেনারেল অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন তখন কিশোরগঞ্জ,সিলেট এ রকম বহু জায়গায় যুদ্ধ চলছিলো। কিশোরগঞ্জে মওলানা আতাহার আলী ১৬ তারিখের পরও কয়েকদিন পাকিস্তানের পতাকা নামাতে রাজী হননি। পরে তাঁকে বুঝিয়ে শুনিয়ে পতাকা নামাতে রাজী করানো হয়।

১৫ই ডিসেম্বর রাত্রের অবস্থা বর্ণনা করা সহজ নয়। তখন অনেক গেরিলা ঢাকায় প্রবেশ করছে। সারা রাত ভরে গোলাগুলির আওয়াজ কানে আসতে থাকে। আরো শুনি যে আগামীকাল রমনার মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান আর্মি আত্মসমর্পণ করবে, সত্য জেনেও তখনো এ কথা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা শক্ত ছিলো যে পাকিস্তান সত্যি সত্যি ভেঙ্গে পড়ছে। সারারাত ধরে ৪৭ সালের আগস্ট মাসের উৎসাহ উদ্দীপনা এবং আদর্শবাদের কথা ভাবি। যারা তখন পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে বাংলার আকাশ বাতাস ভরে তুলেছিলো তাদেরই একদল আজ ‘জয় বাংলা’ চিৎকার করে আহ্লাদে ফেটে পড়ছে- এ ছিলো আমার জন্য এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। মনে হয়েছিলো আমরা যেনো এলিসের ওয়ান্ডার ল্যান্ডের মতো কোনো দেশের অধিবাসী যেখানে কোন কিছুরই স্থিরতা নেই। ভাবলাম এটা কি আমাদের চরিত্রের বৈশিষ্ট? মনে হয়েছিল, যে ফজলুল হক সাহেব ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন তিনিই ১৯৪৬ সালে ইলেকশনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন এবং একবার কোলকাতা হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার পথে পাকিস্তান সম্বন্ধে এমন এক উক্তি করেছিলেন যার ফলে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী তাঁকে দেশদ্রোহী বলতে বাধ্য হন। মওলানা ভাসানী যিনি সিলেটের গণভোটের সময় এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন, তিনিও একবার পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ জানিয়ে ছিলেন। এ রকম আরো অনেক লোকের কথা জানতাম যাঁরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুহুর্তেই পাকিস্তানের আদর্শে আস্থা হারিয়ে নানা কথা বলতেন। আমি বরঞ্চ কাজী আব্দুল ওদুদ বা সৈয়দ মোজতবা আলীর মতো ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা করি। তাঁরা পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেননি এবং প্রথমাবধি পশ্চিম বাংলায় থেকে যান। তারপর কংগ্রেসের মুসলিম সদস্য যাঁরা পূর্ব বঙ্গের অধিবাসী ছিলেন তাঁদের মনোবৃত্তিও কিছুটা বুঝতে পারতাম। কুমিল্লার আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ক্ষুদ্ধ হয়ে নেহেরুকে এক চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু যারা এককালে পাকিস্তানের বদৌলতে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হন এবং যাঁরা পাকিস্তান না হলে সমাজের নিম্নস্তরে পড়ে থাকতেন তাঁরা এবং তাঁদের সন্তানেরা যে যুক্তিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সেই যুক্তি আমার বোধগম্য ছিলো না।

১৫ তারিখ রাত্রে আরও ভাবি যে, যে পরিবর্তন আসছে তাতে আমার নিজের জীবন বিপন্ন হতে পারে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে কোনো স্বস্তিই পাচ্ছিলাম না। নয় মাসে চারদিকে প্রতিহিংসার আগুন যেভাবে জ্বলে উঠেছিলো তাতে দেশের এবং সমাজের কোনো মঙ্গল হতে পারে এ কথা বিশ্বাস করা ছিলো আমার পক্ষে অসম্ভব।


তাছাড়া আরেকটা কথা ভাবি, এই তথাকথিত মুক্তিবাহিনী যদি নিজেরা যুদ্ধ করে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো তাতেও অগৌরবের কিছু আমার চোখে পড়তো না। বিচ্ছিন্নতাকে আমি সহজে মেনে নিতে পারতাম না সত্যি কিন্তু তা হলেও মনকে এই বলে প্রবোধ দিতে পারতাম যে বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণে পাকিস্তান টুকরো হয়ে গেছে। কিন্তু যা হতে যাচ্ছিলো সেতো বিদেশী একটি রাষ্ট্রের সাহায্যে একটি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা মাত্র। ইন্ডিয়ান আর্মি এই দেশকে যুদ্ধে পরাজিত করে আনুষ্ঠানিকভাবে এটা দখল করতে আসছিলো। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের বা যারা এখন নিজেদের বাঙালী বলতে শুরু করেছিলো তাদের গৌরবের কি থাকতে পারে? এরা ইচ্ছা করে একটা বিদেশী শক্তির কাছে দেশকে তুলে দিতে যাচ্ছিলো এবং এর নাম দিয়েছিলো স্বাধীনতা। শুনেছি এখনো কোলকাতায় নাকি পূর্ব পাকিস্তান বিজয় দিবস উদযাপিত হয়। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ইন্ডিয়া বিজয় লাভ করেছিলো এতে কোনো সন্দেহ নেই। যে কৌশলে ইন্ডিয়া বিজয় লাভ করে নৈর্ব্যক্তিকভাবে তারও প্রশংসা আমি করতে পারি। কিন্তু পাকিস্তানী হিসাবে এটা আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না।

আরও মর্মাহত হচ্ছিলাম এই ভেবে যে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু অধিবাসী, সংখ্যালঘু পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে যে মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিল তার মধ্যে বীরত্বের কিছু ছিল না। যুক্ত বাংলায় যেমন সংখ্যাগুরু হয়েও মুসলমানেরা হিন্দুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে যেত, এখানেও তাই। অথচ এটাকে বলা হচ্ছিল বাঙালীর সাহস ও বীরত্বের প্রতীক।

১৬ই ডিসেম্বর ভোরে উঠে দেখলাম প্রায় বাড়ীতেই ‘জয় বাংলা’ পতাকা। তবে আমাদের মহল্লায় রাস্তায় কোন উল্লাস হয়নি। দিন দশটার দিকে নাকি জেনারেল অরোরা এবং অন্যান্য ইন্ডিয়ান অফিসার রমনার মাঠে উপস্থিত হন এবং এঁদের কাছে জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেন। শুনেছি তিনি নাকি তখন কেঁদে ফেলেছিলেন।

এ সময় গভর্নর মালেক এবং তাঁর মন্ত্রীরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই হোটেলটিকে ‘নিউট্রাল গ্রাউন্ড’ বলা হতো। বিদেশী সাংবাদিকরাও এখানে থাকতেন।

সবচেয়ে দুঃখ পেলাম যখন শুনলাম যে আমাদের পরিচিত কোন কোন পরিবার বিরিয়ানী রান্না করে ইন্ডিয়ান সৈন্যদের জন্য পাঠাচ্ছে। আমার নিজের ফুপাতো ভাই হাসিনা মঞ্জিলের সৈয়দ ফখরুল আহসানের মেয়েরা এরকম দু’ডেক পোলাও রমনা কিংবা ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে ছিলো। এ ছিলো এক অদ্ভূত দৃশ্য।

পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণ হলেও ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করেন যে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। এই যুদ্ধ বন্ধ হয় আমেরিকার হুমকিতে। অথচ পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার জন্য আমেরিকা কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। একবার শোনা গিয়েছিলো যে আমেরিকার সপ্তম নৌবহর পূর্ব পাকিস্তানের দিকে এগিয়ে আসছে। এ খবর কদ্দুর সত্য তা আমি এখনো জানি না। তবে চাপ দিলে ইন্দিরা গান্ধী যে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য পাঠাতে সাহস পেতেন না তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

১৬, ১৭, ১৮ ডিসেম্বর মহা উৎকন্ঠার মধ্যে কাটে। তখন চারদিক থেকে শুধু হত্যাকান্ডের খবর আসছিল। পাকিস্তান সমর্থক বলে যাদের উপরই সন্দেহ হয়েছে তাদেরই বিনা বিচারে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ছিল কয়েক হাজার বিহারী এবং বহু বাংলা ভাষী মুসলমান। ১৭ তারিখে বোধ হয় সৈয়দ আলী আহসানের ছোট ভাই সৈয়দ আলী নকী আমার সাথে দেখা করতে আসে। সে বলে, সাজ্জাদ ভাই! আপনি এখান থেকে সরে যান। আমি জবাব দিয়েছিলাম যে, আমি পাকিস্তানে বিশ্বাস করতাম এ কথা সত্য কিন্তু আমি কোন খুন জখম বা অনুরূপ অপরাধ করিনি। আমি পালাবো কেনো? তাছাড়া পরিবারকে অরক্ষিত অবস্থায় রেখে আত্মগোপন করা হবে চরম কাপুরুষ। যদি আমার নসিবে মৃত্যূ থাকে সেটা রোধ করা অসম্ভব হবে। কিন্তু পালিয়ে আমি কাপুরুষতার দুর্নাম অর্জন করতে রাজী নই।

১৯ তারিখে ভাইস চান্সেলরের সেক্রেটারিকে খবর দিলাম সে যেনো ফাইল নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করে। সে আমাকে ফাইল পাঠিয়ে দিলো কিন্তু নিজে আসতে সাহস পেলো না। পরে শুনেছি ক্যাম্পাসে ১৬ তারিখ থেকেই আমার খোঁজাখুঁজি শুরু হয়।

ফাইলে আমি যে কথাগুলি লিখেছিলাম তা আমার মনে আছে। আমি যে ১৬ তারিখের পর টিক্কা খানের আদেশে যে সমস্ত শিক্ষক চাকুরীচ্যূত হয়েছিলেন তাঁদের উপর আরোপিত সে আদেশ এখন অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে।

১৯ তারিখ সকাল বেলা রেডিওতে যে ঘোষণা শুনি তাতে মনে হয়েছিলো যে আমার বিপদ খুব কাছিয়ে এসেছে। সেদিন রেডিও খুলতেই এক পরিচিত ছাত্র নেতা আ স ম আব্দুর রবের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। সে গভর্নর মালেক, সবুর খান, ফজলুল কাদের এবং হাসান জামানের নাম উল্লেখ করে বললো যে এঁদের কি শাস্তি হওয়া উচিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছিল সে প্রাণদন্ডের কথাই বলছে। আমার নাম এ ঘোষণায় ছিলো না কিন্তু ঘোষণাটি শোনা মাত্র আমার পাশের বিছানায় শোওয়া ফুপাতো ভাই সৈয়দ কামরুল আহসানকে বলি, আমাদের দিন ফুরিয়ে গেছে। হয় তো শিগগির আমাদের ধরতে আসবে।

ঐ দিন বিকাল সাড়ে তিনটার সময় আমি উপর তলায় আমার বড় মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম। হঠাৎ একটা গন্ডগোলের শব্দ কানে এলো। মনে হলো কতগুলি লোক আমাদের বাড়ীর ভিতরে ঢ়ুকে উপরে আসার চেষ্টা করছে। বাড়ীর অন্যান্য মেয়েরা তাদের থামাতে চেষ্টা করছে। মুহুর্তেই টের পেলাম যে এরা আমার জন্য এসেছে। আমি নিচে যাওয়ার চেষ্টা করতেই আমার মেয়ে আমাকে টেনে ধরে দরোজা বন্ধ করে দিলো। আমি বললাম, এতে লাভ হবে না। তোমরা এভাবে আমাকে বাঁচাতে পারবে না। এ কথা শেষ না হতেই মনে হলো একদল লোক ছাদের উপর উঠে এসেছে। প্রচন্ড জোরে লাথি দিয়ে ছাদের দিকের দরোজাটা ভেঙ্গে ফেললো। আমাকে দেখা মাত্র বললো, ‘হ্যান্ডস আপ’। যেনো আমার কাছে কোন বন্দুক বা পিস্তল ছিলো। তারপর এ ভাঙ্গা দরোজা দিয়ে ঢুকে আমার শার্ট ধরে ওরা আমাকে টেনে নামিয়ে নিয়ে যায়। শীতের দিন আমার পরনে ছিলো পশমী প্যান্ট এবং শার্টের উপর কার্ডিগ্যান। চারদিকে তাকাবার অবসর ছিলো না। যারা আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তাদের সবার হাতে অস্ত্র। আমাকে যখন বাইরে নিয়ে আসা হলো তখন দেখলাম গেটের সামনে একটি  খোলা জিপ। এবং জিপের দু’দিকে মহল্লার লোকজন জড়ো হয়ে আছে। কেউ কিছু বললো না। বুঝতে পারলাম আমি কতটা অসহায়। আমাকে ঠেলে ওরা জিপে উঠিয়ে দিলো। মনে হলো এই আমার শেষ যাত্রা। হয়তো এখনি নিয়ে আমাকে মেরে ফেলবে।

অধ্যায় ৮ এর অবশিষ্ট অংশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>