সংকটের সূচনা
৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যখন রাজনৈতিক দূর্যোগ ঘনিয়ে আসে তখন আমি রাজশাহীতে। ভাইস চান্সেলর পদে অধিষ্ঠিত। ডিসেম্বরের নির্বাচনের পরই দেশের আবহাওয়ায় একটা গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। নির্বাচনের পূর্বেই আওয়ামী লীগ নেতারা ঘোষণা করেছিলেন যে, তাদের ছয় দফা দাবী আলোচনা সাপেক্ষ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের ব্যপারে স্থির নিশ্চয় হলেও এর খুটিনাটি সম্বন্ধে আলোচনা করতে রাজী থাকবেন। অথচ যখন দেখা গেল দু’টো আসন ছাড়া আওয়ামী লীগ সবগুলো আসনই দখল করতে সমর্থ হয়েছে তখন তারা বললেন যে, ছ’দফার কোন নড়চড় হবে না। এই অনমনীয় মনোভাব সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ বহির্ভূত অনেকের ধারণা ছিল যে শেষ পর্যন্ত একটা আপোষ করা সম্ভব হবে। কারণ ছ’দফায় স্বায়ত্তশাসনের কথা ছিল, স্বাধীনতার দাবী ছিল না। কিন্তু নির্বাচনে বিজয়ের পরক্ষণেই ঘোষণা করা হল যে আওয়ামী লীগ নেতা রাজনৈতিক আলোচনার জন্য ইসলামাবাদে যাবেন না এবং গণপরিষদের বৈঠক পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হতে হবে। সংসদে নবনির্বাচিত সদস্যরা ঢাকায় বসে হলপ গ্রহণ করলেন যে তারা ছ’দফা থেকে কিছুতেই বিচ্যুত হবেন না।


এ সমস্ত ঘটনায় আমরা অনেকেই শংকিত বোধ করতে শুরু করি। জানুয়ারী মাসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যখন প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ নেতাকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী রূপে স্বীকৃতি দান করেন তখন ক্ষণকালের জন্য মনে হয়েছিল যে বিপদ কেটে যাবে, কিন্তু এই সময়েই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিহারী এবং ইসলামপন্থী লোকজনের উপর অত্যাচারের কাহীনি প্রচারিত হতে থাকে। এই অত্যাচার কোন কোন ক্ষেত্রে নিধনযজ্ঞে পরিণত হয়। সারা ফেব্রুয়ারী মাস ধরে এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। এ সময় কত লোক নিহত হয়েছে তার কোন হিসাব প্রকাশিত হয়নি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ যখন বলতে শুরু করে যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারা ইচ্ছামত একটি শাসনতন্ত্র গঠন করবে, তখন দুর্যোগের আশঙ্কা আরো ঘণীভূত হয়ে ওঠে। ইয়াহিয়া সাহেব আওয়ামী লীগের চাপের মুখে গণপরিষদের বৈঠক ঢাকায় স্থানান্তরিত করতে সম্মত হন। কিন্তু আওয়ামী লীগের হুমকিতে ভীত হয়ে জুলফিকার আলী ভূট্টো ঘোষণা করেন যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যদি শাসনতন্ত্র গঠিত হয়, তাহলে তাদের পক্ষে গণপরিষদে যোগদান করা নিরর্থক হয়ে উঠবে। তাছাড়া তিনি এ আশঙ্কাও প্রকাশ করেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যরা ঢাকায় জিম্মি হয়ে পড়বেন। পিপলস পার্টির বহির্ভূত সদস্যরাও যাতে ঢাকায় আসার পরিকল্পনা ত্যাগ করতে বাধ্য হন সে উদ্দেশ্যে ভূট্টো সাহেব তাদের বাড়ীঘর পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকেন।


এই পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এবং দুর্ভাগ্যবশতঃ পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ না করেই জেনারেল ইয়াহিয়া গণপরিষদের বৈঠক মূলতবি ঘোষণা করেন। এটা ১লা মার্চের ঘটনা। তখন রাজশাহীতে কতগুলো পরীক্ষা শুরু হয়েছে। গণপরিষদ মূলতবির খবর আমার নিজের কানে পৌছবার আগেই শুনলাম, পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা বর্জন করে হল থেকে বেরিয়ে এসেছে। পরীক্ষারত ছাত্ররা কীভাবে গণপরিষদের খবর পেয়েছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে এতগুলো ছাত্র সমবেতভাবে কীভাবে হল ত্যাগ করলো সেটা এখনও আমার কাছে রহস্যময় মনে হয়। এর পিছনে নিশ্চয়ই কোন পূর্বসিদ্ধান্ত কাজ করেছে। সে যাই হোক, সন্ধ্যায় একদল ছাত্র এসে দাবী করলো যে খুলনায় অনুষ্ঠিতব্য পরীক্ষাগুলি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। অবশ্য তার আগেই অন্যান্য কেন্দ্রের পরীক্ষাও তারা বর্জন করতে শুরু করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছিল না।

৭ই মার্চ

রাজনৈতিক আপোষের সমস্ত সম্ভাবনাই যেনো নিঃশেযিত হতে লাগলো। ৭ই মার্চ রমনা ময়দানে যে সমস্ত ঘটনা ঘটে তারপর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠি। সেই সময়ের ইত্তেফাকে একটি সস্পাদকীয়র কথা মনে পড়ে। ইত্তেফাক আওয়ামী লীগের সমর্থন করতো। কিন্তু দেশে একটা গৃহযুদ্ধ ঘটুক এটি তারা কামনা করেনি। তাই সম্পাদকীয় প্রবন্ধে শুভবুদ্ধির অবক্ষয় নিয়ে আক্ষেপ করা হয়। যদ্দুর মনে পড়ে প্রশ্ন করা হয়, আমরা কী সত্যি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছি! ১৫ই মার্চ থেকে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের আলোচনা আরম্ভ হয়। তখনো যে সমস্ত কথা শুনেছি তাতে আতঙ্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। বলা হয় যে ইয়াহিয়া এসেছেন অতিথি হিসেবে, অর্থাৎ তিনি যে দেশের প্রেসিডেন্ট সেটা আর সত্য নয়া। এতদসত্তেও ব্যক্তিগতভাবে আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে ওঠে যে জেনে শুনে সজ্ঞানে দেশটাকে গৃহযুদ্ধের মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে। আমাদের জীবদ্দশায় তিরিশের দশকে স্পেনের গৃহযুদ্ধের স্মৃতি আমাদের মনে উজ্জ্বল ছিলো; তার ভয়াবহতার কথা আমরা ভুলতে পারিনি। ইরাকে এবং দক্ষিণ আমেরিকার দেশে দেশে সহিংস অভ্যূত্থানের কথা আমরা জানতাম। মহাযুদ্ধের শেষে গ্রীসে এবং যুগোশ্লাভিয়ায় অন্তর্দ্বন্ধের ফলে যে রক্তপাত ঘটে সে কথা তখন নেতৃবৃন্দের মনে নিশ্চয়ই ছিলো। তাই কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে অনুরূপ প্রথায় পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে আমরা রাজনৈতিক সমাধানের পথ সন্ধান করবো।


২২ বা ২৩ তারিখে যখন উদ্বেগ চরমে উঠেছে, আমি পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক আবদুস সালাম সাহেবকে ফোন করি। তিনি বললেন যে তিনি আশা করেন যে শেষ পর্যন্ত একটা সমঝোতা হবে। এতে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু সব উদ্বেগ ও আতঙ্ক দূরীভূত হয়নি। রাজশাহীতে রাজনৈতিক সংবাদের জন্য আমাদের নির্ভর করতে হতো ঢাকায় প্রকাশিত খবরের কাগজ এবং গুজবের উপর। গুজবে স্বভাবতই ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হতো, আর এ কথাও মনে হয়েছে যে ইউনিভার্সিটির ভিতরে এবং বাইরে একদল লোক ছিল যারা উদগ্রীব হয়ে গৃহযুদ্ধের অপেক্ষা করছিল। একদিন খবর পেলাম, কোনো হলের একটি ছাত্র এ্যাকসিডেন্ট করে জখম হয়েছে। খোঁজ করে জানা গেল সে গেরিলা যুদ্ধের প্রাকটিস করছিল। পাইপ বেয়ে ছাদে উঠবার সময় পড়ে যায়। এ রকম ছোট-খাট ঘটনা প্রায় রোজই হতো।

২৩শে মার্চ
২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবস। সত্তর সালেও মহাসমারোহে এই দিবস পালন করা হয়। ইউনিভার্সিটির সমস্ত ইমারতের উপর পাকিস্তান পতাকা উড্ডীন করে আমরা দিবসটি উদযাপন করেছিলাম, কিন্তু ‘৭১ সালের ২৩ শে মার্চ ভোর বেলা উঠে দেখলাম, এডমিনিষ্ট্রেশন বিল্ডিং এর উপর ছাত্ররা বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে, সবুজ পটভুমির উপর একঢি রক্তবর্ণ গোলক এবং তার উপর পূর্ব পাকিস্তানের নকশা। ছাত্ররা এটাকে বাংলাদেশের পতাকা বলতো। তখন পরিস্থিতি এত নাজুক যে পতাকাটি নামিয়ে ফেলার চেষ্টা করলে অনিবার্যভাবে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ ঘটতো। আমরা বাধ্য হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে রইলাম। ২৪ তারিখে আবার ঢাকায় ফোন করলাম। এবার আমার এক আত্মিয়ার কাছে। মেয়েটির বিবাহ হয়েছিল এক রাজনৈতিক পরিবারে। ভাবলাম সে হয়তো সঠিক খবরটি দিতে পারবে। সে বললো আজকের মধ্যে হয় একটা ফয়সালা হবে নয়তো ইয়াহিয়ার সঙ্গে যে আলোচনা হচ্ছিল তা ভেঙ্গে যাবে। শুনলাম ঢাকার আবহাওয়া খুবই থমথমে।
২৬ শে মার্চের প্রত্যূষ

২৬ তারিখে খুব ভোর বেলা নাইট গার্ড আমাকে বললো চারিদিকে গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, আমি যেন হঠাৎ করে নিচে না নামি। ২৫ তারিখ রাত্রের ঘটনা সম্পর্কে আমরা কেউ কিছু জানতাম না। রাত্র এগারটার সময় যখন শুতে যাই তখনও রেডিওতে কিছু বলা হয়নি। নাইট গার্ডরাও কিছু টের পায়নি, প্রতিদিনের অভ্যস মত সকাল বেলায় যখন গোসল করছি তখন আবার নাইট গার্ড খবর পাঠালো, “স্যার! আপনি নিচে আসুন মিলিটারী অফিসাররা আপনার সাথে কথা বলবেন।” আমি তাড়াতাড়ি করে গোসল সেরে নিচে নামলাম। গাড়ি বারান্দায় পা দিয়েই দেখলাম সামনে একজন ছোকরা অফিসার দাঁড়ানো। আমাকে দেখেই সে বললে, আপনি কারফিউ ভঙ্গ করছেন। আমি বললাম, কিসের কারফিউ? আর এটাতো আমার নিজের বাসা। সে বললো, দালানের বাইরে গেলেই কারফিউ ভঙ্গ করা হবে। সারাদেশে কারফিউ জারী করা হয়েছে এবং মিলিটারী দেশের শাসনভার দখল করেছে। আমি বললাম, আমি তাহলে ফিরে যাচ্ছি। জবাবে সে আমাকে বললো, না আপনি আসুন, আপনার সাথে কথা আছে। আমি লনে পা দিতেই সে বললো, আপনার বাসায় কালো ফ্ল্যাগ কেন? প্রসঙ্গক্রমে বলা প্রয়োজন যে ছাত্রদের চাপের মুখে আমরা কালো ফ্ল্যাগ উড়াতে বাধ্য হয়েছিলাম। এবার সংকটে পড়লাম, ছোকরা অফিসারটি দাবী করলো যে কয়েক মিনিটের মধ্যে ঐ ফ্ল্যাগ নামানো না হলে আমার চাপরাশিকে সে গুলি করবে। আমি মোখতারকে বললাম, তুই শিগগির ফ্ল্যাগটি নামিয়ে নিয়ে আয়।

ছোকরা অফিসার এরপর আমাকে বললো যে সারা ক্যাম্পাস মিলিটারির দখলে এবং কেউ কারফিউ ভঙ্গ করলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করা হবে। আমি বললাম, আমি তাহলে ফোনে সবাইকে কারফিউয়ের কথা জানিয়ে দিচ্ছি। অফিসারটি হেসে বলল, কাল রাত ১২ টার পর থেকে আমরা সব ফোনের লাইন কেটে দিয়েছি, তারপর বলল আপনি আমার সঙ্গে গেইট পর্যন্ত হেটে আসুন। যদি কাউকে দেখা যায় তাকে কারফিউ সম্পর্কে হুশিয়ার করে দেবেন। আমার সঙ্গে যেতে যেতে অফিসারটি প্রকাশ করলো যে গত রাতে তারা শহরে বহু লোককে গুলি করেছে। এর মধ্যে একজন ছিল ইউনিভার্সিটির নাইট গার্ড। আমি চমকিত হয়ে উঠলাম। শুনলাম, গভীর রাতে আর্মির লোকজন যখন এডমিনিষ্ট্রেশন বিল্ডিং – এ প্রবেশ করার চেষ্টা করে, নাইটগার্ড তাদের চ্যালেঞ্জ করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে তার উপর গুলি করা হয়। কয়েক ঘন্টা রক্তক্ষরণের পর শেষ রাত্রির দিকে তার মৃত্যূ ঘটে। আশেপাশে কেউ ছিলো না; তার চিৎকারও কেউ শোনেনি। সে দিন সন্ধ্যা বেলায় লাশ উদ্ধার করে লোকটির দাফনের ব্যবস্থা করা হয়।

আমরা দু’জন যখন গেইটে পৌছালাম তখন দেখা গেলো দু’জন শিক্ষক প্রাতঃ ভ্রমণে বেরিয়েছেন। অফিসারটি বললো, এরা যদি এক্ষুণি বাসায় ফিরে না যায় তাহলে গুলি করা হবে। বললাম, একি কথা! এরা তো কেউ কারফিউয়ের কথাই জানে না। শিক্ষক দু’জন গেইটের কাছাকাছি এলে আমি তাদের সব কথা বুঝিয়ে বললাম। তারা ভয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়লেন, একা ফিরে যেতে সাহস পাচ্ছিলেন না। বললেন পথে আর কোন সৈন্য আমাদের দেখলে গুনি করে দেবে, তখন ওদের বাসায় পৌছে দেওয়ার জন্য এক জওয়ানকে সঙ্গে দেওয়া হলো। ঠিক তখনি রাস্তার অন্যদিক থেকে এক জওয়ান দু’জন তরুণ শিক্ষককে ধরে নিয়ে এল। এরাও নাকি কারফিউ ভঙ্গ করার অপরাধে দায়ী। কিন্তু শোনা গেল এদের জুবেরী হাউজের কামরা থেকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। তারপর আফিসার এদের নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করলো। এরা খুব অল্প বয়স্ক বলে তার বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে এরা শিক্ষক। দু’জনের মধ্যে একজন ছিল হিন্দু। আমি ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে ভাবলাম যে নাম উচ্চারণ করা মাত্র তাকে হয়তো আমার সামনেই গুলি করবে। কিন্তু প্রথমে মুসলমান তরুণটি নাম বলার পর এ নিয়ে ওরা আর পীড়াপীড়ি করলো না। আর এক জওয়ানের সঙ্গে ওদের জুবেরী হাউজে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করলাম।

২৬শের পরবর্তী ঘটনা

দু’দিনের মধ্যে শহরের অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। রাজশাহীতে ছোট্ট একঢি গ্যারিসনে বিশেষ লোকজন ছিল না। ইপিআর- এর সদস্য যারা দল ত্যাগ করে আওয়ামী লীগ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো তাদের চাপের মুখে ক্যাম্পাস এবং অন্যান্য প্রত্যন্ত এলাকা থেকে সৈন্য সরিয়ে নিয়ে গ্যারিসন রক্ষার কাজে নিয়োজিত করা হলো। আমরা পড়লাম মহাফ্যাসাদে। একদিকে আর্মির লোকজনেরা ক্যাম্পাসের পথে এসে টহল দিতো অন্য দিকে আওয়ামী লীগ বাহিনী এ অঞ্চলে অবাধে বিচরণ করে বেড়াতো। সারাদিন শহর থেকে গোলাগুলির শব্দ আসতো। ঢাকার সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। খবরের কাগজ আসা বন্ধ। রেডিওতে যে খবর শুনতাম স্থানীয় পরিস্থিতিতে তার সমর্থন পাওয়া যেতো না। মনে হচ্ছিল, রাজশাহী অঞ্চলটি পুরাপুরি আওয়ামী লীগ বাহিনীর দখলে চলে গেছে। একদিন ওরা এসে আমাদের ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের তার কেটে দিলো। তখন শুধু যে অন্ধকারে থাকতে হয়েছে তাই নয়, খাবার পানির সংকটও দেখা দিলো। ক্যাম্পাস তখন প্রায় খালি। ৭ই মার্চের পর প্রায় সব ছাত্র আওয়ামী লীগের আহ্বানে হল ত্যাগ করে চলে যায়। শিক্ষকরাও গ্রামে চলে যেতে লাগলেন। তারা মনে করতেন যে যুদ্ধ-বিগ্রহ যদি কিছু হয় সেটা হবে শহরেই এবং ক্যাম্পাসে, গ্রামে থাকাই নিরাপদ। আরো শোনা গেলো যে বহু লোক পায়ে হেঁটে শুকনো পদ্মার উপর দিয়ে ওপারে (পশ্চিম বাংলা) চলে যাচ্ছে। সবার মনেই আতঙ্ক। শিক্ষকেরাও কেউ কেউ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। একজন যদ্দুর মনে পড়ে ম্যাথমেটিকস ডিপার্টমেণ্টের- তার গাড়িটা আমার কাছে আমানত রেখে চলে গেলেন। একদিন শুনলাম, ইউনিভার্সিটি ব্যাংক – অর্থাৎ হাবিব ব্যাঙ্কের একটি শাখা লুট হয়ে গেছে। মনে হলো ব্যাঙ্কের দু’-একজন কর্মচারীর সহযোগিতায় এই কর্ম সাধিত হয়। নগদ টাকা তো গেলই, ইউনিভার্সিটির শিক্ষক যারা সোনার অলঙ্কার গচ্ছিত রেখেছিলেন তারাও সব হারালেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে কেমিস্ট্রি বিভাগের ডক্টর আঃ লতিফের নাম মনে পড়ছে।

ইন্ডিয়ান মেডিকেল টিম

আরেক দিনের ঘটনা ক্যাম্পাসে তখনো যারা ছিলেন তাদের অবস্থা পরিদর্শন করতে বেরিয়েছি। দেখা হলো একদল ভারতীয় মেডিকেল টিমের সাথে। তারা এসেছেন ইউনিভার্সিটির ডাক্তারদের নিয়ে একঢি ইমারজেন্সি টিম গঠন করার উদ্দেশ্যে। এই দলে এক মহিলাও ছিলেন। আরেক দিন কুষ্টিয়া থেকে সাইকেলে করে এক যুবক আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলো। সে ছিলো রেজিষ্ট্রার জোয়ারদার সাহেবের দূরের আত্মীয়। বললো, যশোর এবং কুষ্টিয়া লিবারেটেড হয়ে গেছে। সেখানে অবাধে ইন্ডিয়ান বাহিনী আনাগোনা করছে এবং কোলকাতার জিনিসপত্র নাকি সুলভে পাওয়া যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ বাহিনী কর্তৃক ইস্যুকৃত একটি আইডেনটিটি কার্ডও সে দেখাল।

আরেক দিন এক জিপে করে লম্বা-চওড়া এক মিলিটারী অফিসার আমার বাসায় এলেন। আমি ভাবলাম, তিনি পান্জাবী। বললাম, আইয়ে। কিন্তু পর মুহুর্তে বুঝলাম ভূল হয়েছে। তিনি বাংলায় বললেন, আপনার বাসায় ‘জয় বাংলা পতাকা’ নেই কেনো তাই খোঁজ করতে এসেছি। আপনি শিগগির জয়-বাংলা পতাকা ওড়ান নইলে অসুবিধে হবে। বললাম, জয় বাংলা পতাকা বাসায় নেই, এবং বর্তমান অবস্থায় সেটা তৈরী করাও সম্ভব নয়। আমরা শুধু কালো পতাকা ওড়াতে পারি। এ নিয়ে তিনি আর পীড়াপীড়ি করলেন না। আমাকে আশ্বাস দিয়ে গেলেন যে শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ বাহিনী এ অঞ্চল দখল করবে।


এরপর একদিন ইউনিভার্সিটির জিয়োগ্রাফি ডিপার্টমেণ্টের এক ছাত্র এসে হাজির। সে আওয়ামী লীগ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো। বললো, খবর পেয়েছে যে পাকিস্তানী আর্মি রংপুরের শিক্ষক-উকিল-মোক্তার-ডাক্তার সবাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে এবং করাচীতে বাঙালী যারা তারাও নাকি নিমর্মভাবে নিহত হয়েছে। সে আরো বললো যে বিদ্রোহী বাহিনী এর প্রতিশোধ নেবে বলে স্থির করেছে। এবং রাজশাহী ইউনিভার্সিঢিতে অবাঙ্গালী শিক্ষক এবং অফিসার যারা ছিলেন তাদের উপর দিয়ে প্রতিশোধ শুরু হবে। আমি যতই তাকে বুঝাবার চেষ্টা করি যে তার রিপোর্ট যদি সত্যিই হয়ে থাকে তবুও নিরপরাধ শিক্ষকদের উপর জুলুম করা কোন রূপেই সঙ্গত হতে পারে না, সে ততই কঠিনভাবে তার প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করতে লাগলো। যাক সেদিন কোন রূপে তাকে নিরস্ত করা গেল। কিন্তু তার দু’-একদিন পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বাংগালী অধ্যাপক আমাকে গোপনে এসে খবর দিলেন যে তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন যে সাইকোলজি বিভাগের ডক্টর মতিয়ুর রহমান ওয়্যারলেসের সাহায্যে পাক বাহিনীকে নানা তথ্য সরবরাহ করছেন। এ কথা শুনে আমিতো স্তম্ভিত। জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি সত্যিই কি দেখেছেন? তিনি বললেন, তিনি ডক্টর মতিয়ুর রহমানকে সন্দেহজনকভাবে বাথরুমের জানালা দিয়ে উকিঁ মারতে দেখেছেন। বললাম এটা কোন প্রমাণ নয়। তিনি তো কোন ওয়্যারলেস যন্ত্র দেখেননি, আর যদি কেউ গোপনে ওয়্যারলেসে আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে চান সেটা বাথরুমের জানালা খুলে অমনভাবে করবেন কেন? তার কাছে এই যুক্তি খুব একটা মনোপুতঃ হলো না। আমি প্রমাদ গুনলাম। বললাম আপনি মেহেরবানী করে খবরটি প্রচার করবেন না। আমি অন্য অধ্যাপকের সাথে পরামর্শ করে স্থির করবো কি করা দরকার। তার উপস্থিতিতেই প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও প্রফেসর ফজলুল হালিম চৌধুরীকে খবর দিলাম। সৌভাগ্যক্রমে তারা সঙ্গে সঙ্গে আমার বাসায় এলেন। সমস্ত ঘটনা শুনে তারাও বললেন, যে খবর শোনা গেলো সেটা সত্য হতে পারে না। এ যাত্রাও রক্ষা পাওয়া গেলো। 

কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে গেল না। কয়েকদিন পরই আরো একটি বা দু’টি ছাত্র এসে ঐ খবরের পুনরাবৃত্তি করলো যোগদিল যে অবাংগালী অধ্যাপক অনেকেই গোয়েন্দাগিরি করছে। আমি তাদের বললাম তোমাদের মনে যদি এ রকম সন্দেহ বদ্ধমূল হয়ে থাকে তাহলে আমার বাসা থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের প্রতিটি বাসা তল্লাশী করে দেখতে পারো। তারা বোধ হয় এরকম জবাবের জন্য প্রস্তূত ছিলো না। পীড়াপীগি করলো না। শুধু বললো, অবাঙ্গালী কোন শিক্ষক যেন ক্যাম্পাস ছেড়ে না যায়। তাদের আশ্বাস দিলাম, ওরা কেউ কোথাও যাবে না। কিন্তু অবাংগালী শিক্ষক এবং বাংগালী অফিসারদের মধ্যে ডেপুটি রেজিষ্ট্রার সৈয়দ ইবনে আহমদের বিরুদ্ধে ক্রমেই একটা হিংসাত্মক ভাব দানা বেঁধে উঠতে লাগলো। ইবনে আহমদের আদি বাড়ী ছিলো বিহারের পূর্ণিয়ায়। উর্দু বলতে পারতেন এটাই তার অপরাধ। একদিন হঠাৎ তিনি সপরিবারে আমার বাসায় এসে হাজির হলেন। বললেন, স্যার আমায় আশ্রয় দিন, বাসায় থাকলে নির্ঘাত আমাকে ওরা হত্যা করবে। তাকে উপরের গেস্টরুমে জায়গা দেওয়া হলো। 

তারপরের ঘটনা আরো ভয়ঙ্কর। তারিখটা আমার মনে নেই। এপ্রিল মাসের তিন-চার তারিখের ব্যাপার। দুপুরবেলা রাইফেলধারী দু’জন লোক এসে বললো যে ডক্টর মতিয়ুর রহমানের বাড়ী ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। গোয়েন্দাগিরির অপরাধে তাকে এক্সিকিউট করা হবে। এর মধ্যে অর্থনীতি বিভাগের ডক্টর মোশাররফ হোসেন দৌড়ে এলেন। তাকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। তিনি বললেন অবিলম্বে ডক্টর মতিয়ুর রহমানকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করুন; আপনি সেখানে চলুন। আমি রেজিষ্ট্রার জোয়ারদার সাহেবকে খবর দিয়ে তাকে সঙ্গে করে ডক্টর মতিয়ুর রহমানের বাসায় চললাম, আমার দু’পাশে বন্দুকধারী যুবক দু’টি আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে চললো। বাসার সবাই আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল, কিন্তু আমি তাদের বারণ শুনলাম না। পেছনে পেছনে বাসার এক ছোকরা (মুক্তার)ও চললো।

কয়েক মিনিটের মধ্যে ডক্টর মতিয়ুর রহমানের বাসায় এসে দেখি সত্যি সত্যি বন্দুকধারী বেশকজন লোক বাসা ঘিরে ফেলেছে। ভিতরে ড্রয়িংরুমে ঢুকেই দেখি মতিয়ুর রহমান বসা। সঙ্গে রয়েছেন আরবী বিভাগের ডক্টর আব্দুল বারী আর আওয়ামী বাহিনীর দু’জন লোক -একজনের হাতে বন্দুক। স্বভাবতই ভয়ে ডঃ মতিয়ুর রহমান বিবর্ণ হয়ে গেছেন। উপর তলা থেকে চাপা কান্নাকাটির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। অওয়ামী বাহিনীর লোক দু’টির মধ্যে একটি ছিলো জিয়োগ্রাফী ডিপার্টমেন্টের ছাত্র। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কেনো এসেছে। বললো তারা সুনিশ্চিত খবর পেয়েছে যে ডঃ মতিয়ুর রহমান আর্মির গোয়েন্দা অতএব তাকে তারা মাফ করবে না। এবং অন্য অবাংগালী যারা আছেন তাদের ধরে নিয়ে যাবে। অবশ্য একথা বললো না যে এদের তখনি এক্সিকিউট করবে। বললো এদের এক ক্যাম্পে আটক করে রাখা হবে। এবং আরো সাক্ষ্য প্রমাণ পেলে এদের গুলি করা হবে। আমি বললাম, তারা কি ভাবতে পারে যে ভাইস চান্সেলর হিসেবে আমি আমার অধীনস্থ শিক্ষক বা অফিসারকে তাদের হাতে সজ্ঞানে তুলে দিতে পারি? তারা বললো, আমি না দিলে সমস্ত অঘটনের জন্য আমাকে ব্যাক্তিগতভাবে দায়ী করা হবে। তারা শুধু এক শর্তে আপাততঃ এদের ক্যাম্পাসে ছেড়ে দিয়ে যেতে পারে। অবাংগালী শিক্ষক এবং অফিসার সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করে রাখতে হবে এবং লিখিতভাবে মুচলিকা দিতে হবে যে এদের কাউকে ক্যাম্পাস থেকে আমি পালিয়ে যেতে দেবোনা। বললাম, তোমরা চুক্তিপত্র তৈরি করো আমি সই করে দেবো। তখন একটা দলিল তৈরী করা হলো তাতে লেখা হলো যে অবাংগালী সবাই আমার জিম্মায় থাকবে এবং এদের মধ্যে একজনও যদি বেড়িয়ে যান, শাস্তি হবে আমার। আমি সই করলাম। সাক্ষী হিসেবে ডক্টর বারী সই করলেন। জোয়ারদার সাহেবকে বলাতে তিনি মাফ চাইলেন। আওয়ামী বাহিনীর দু’সদস্য দলিলে দস্তখত করলো। ভাবলাম, বিপদ কেটে গেলো। বলা আবশ্যক যে দলিলটিতে অবাংগালী শিক্ষক ও অফিসার সবার নাম লিখতে হয়েছিল। হঠাৎ জিয়োগ্রাফী ডিপার্টমেণ্টের ছাত্রটি দাবী করে বসলো যে এদের সবাইকে আনিয়ে ওদের দেখাতে হবে যাতে পরে চিন্তে অসুবিধা না হয়। সবাইকে খবর দিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই জিয়োগ্রাফী বিভাগের ডক্টর প্যাটেল ও ডক্টর শামসী এসে উপস্থিত হলেন। আমি তাদের বললাম যে এ ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না। আপনারা ভুল বুঝবেন না। তারা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। সৌভাগ্যক্রমে আর কেউ আসবার আগেই ঐ ছেলে বললো, আর দরকার নেই, আমরা যাচ্ছি। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। এরপর সবাইকে অনুরোধ করলাম যে আমাদের তথাকথিত চুক্তি মোতাবেক তারা যেনো ইউনিভারসিটির বহুতলা বিশিষ্ট একটি আবাসিক বিল্ডিং-এ আশ্রয় গ্রহণ করেন। সে রাত্রের মধ্যেই সবাই এ ক্যাম্পে এসে হাজির হলেন। এখানে বলা প্রয়োজন যে বাংগালী শিক্ষক অনেকে ক্যাম্পাস ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছিলেন বলে তখন বহু বিল্ডিং খালি পড়েছিলো। এদিক দিয়ে কোনো অসুবিধে হলো না। কিন্তু ব্যাপারটার একটা অমানবিক দিক ছিলো যা বিবেকবান প্রত্যেক ব্যক্তিকেই পীড়িত করেছে। বিল্ডিং এ আশ্রিত মানুষগুলো যেনো কোরবানীর জানোয়ার, কোনদিন জবেহ হবেন তার অপেক্ষায় রইলেন। আমি নিশ্চিত জানতাম যে এদল থেকে একটি লোকও ক্যাম্পাস থেকে সরে গেলে বাকী সকলে তো নিহত হবেন আমাকেও চরম অসুবিধায় পড়তে হবে, হয়তো আমাকে গুলি করবে।

বিমান বাহিনীর হানা

ডক্টর মতিয়ুর রহমান সম্পর্কে যে গুজব রটেছিলো তা যে কতো ভিত্তিহীন তার একটা প্রমাণ এই যে এ সময়, অর্থাৎ আমি এপ্রিল মাসের প্রথম ১২ দিনের কথা বলছি, পাকিস্তানী বিমান বাহিনী প্রায় দৈনিক একবার ক্যাম্পাসের উপর হানা দিত। মনে হয় তাদের ধারণা হয়েছিল যে ক্যাম্পাস বিদ্রোহী বাহিনীর বড় আড্ডা। ভাইস চান্সেলরের বাড়ীর উপরও হামলা হয়। শেষ পর্যন্ত ডক্টর মোশাররফ হোসেনের পরামর্শে আমি দিনের বেলায় তার বিল্ডিং -এর পাশের একটি বিল্ডিং এ আশ্রয় নিয়েছিলাম। ওটা ছিলো ক্যাম্পাসের এক প্রান্তে, কিন্তু পরদিন দেখা গেলো ঐ অঞ্চলেও বিমান হামলা হচ্ছে। এরপর স্থির করলাম আর নড়াচড়া করবো না।

ক্যাম্পাস প্রায় শূণ্য হয়ে গিয়েছিল। শিক্ষক এবং অফিসার যাদের গাড়ী ছিল তারা গাড়ীতে করে গ্রামে চলে গেলেন। যাদের গাড়ী ছিল না তারা গরু মোহিষের গাড়ী ভাড়া করে ক্যাম্পাস ত্যাগ করলেন, যে ক’জন অবশিষ্ট রয়ে গেলেন তাদের মধ্যে ছিলেন ডঃ আব্দুল বারী, ডঃ আব্দুর রকিব এবং আমার পারসনাল সেক্রেটারী আইনুল হুদা। একদিন যখন আমি অবাংগালী শিক্ষকদের দেখতে গিয়েছি ডক্টর বারী কাঁদো কাঁদো অবস্থায় বললেন যে তাকে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে যে তার নাম আওয়ামী বাহিনীর লিস্টে আছে। ক্যাম্পাসে থাকা নিরাপদ মনে করেন না। আমি তাকে অবিলম্বে গ্রামে চলে যেতে পরামর্শ দিলাম। তার একদিন বা দু’দিন পর আইনুল হুদা এসে বললো যে পরিবারের চাপে সেও ক্যাম্পাসে থাকতে পারছে না। কেঁদে কেঁদে আমার কাছ থেকে বিদায় নিলো। আমার বাসার একদিকে শুধু রইলেন ফিজিক্স এর প্রফেসর ডঃ আহমদ হোসাইন, রেজিষ্ট্রার জনাব জোয়ারদার। একটু দূরে কেমিস্ট্রির প্রফেসর আবদুল লতিফ। ইসলামিক হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপিকা মিসেস লুৎফর রহমান। আরো ছিলেন কন্ট্রোলার অব এক্সামিনেশন মোঃ ফারুক। আহমদ হোসাইন সাহেব ফ্যামিলী বাসায় রেখে ক্যাম্পাসের অদূরবর্তী এক গ্রামে যেয়ে রাত কাটাতেন। দু’একদিন পর পর এসে ফ্যামিলির খোঁজ খবর নিতেন। তখন চারদিকের হাট বাজার বন্ধ। মাছ, মুরগী, তরকারী পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিলো। তবে সেবার আমার বাসায় পুকুরের চারদিকে অসংখ্য টমেটো হয়েছিলে। রোজ প্রায় বিশ-তিরিশ সের টমেটো ছোকরারা কূড়িয়ে আনতো। যথাসম্ভব নিকটবতীঁ অন্য সব ফ্যমিলিকেও সেগুলি বিতরণ করতাম।

চাপরাশি মজিদ

নয় বা দশ তারিখে ভাইস চান্সেলরের ব্যক্তিগত চাপরাশি মজিদকে কাজলায় এক গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করা হয়। লোকটি ছিল বিহারী। ছোটকালে কলকাতা থেকে পূর্ব পাবিস্তানে চলে আসে এবং রাজশাহীতে বিয়ে শাদী করে বসবাস করছিলো। গন্ডগোলের সময় একদিন এসে সে তার রেডিওটি আমার বাসায় জমা দিয়ে যায়। আমি তাকে সপরিবারে আসতে বলেছিলাম। সে বললো, প্রাণের ভয় নেই তবে বাসা লুট হয়ে যেতে পারে সে জন্য আমার একমাত্র সম্পত্তি রেডিওটি গচ্ছিত রেখে যাচ্ছি। তারপর পেলাম তার মৃত্যূ সংবাদ। অনুসন্ধান করে জানা গেলো যে দু’দিন আগে সে প্রাণভয়ে তার এক বাংগালী বন্ধুর বাসায় ক্যাম্পাসে আশ্রয় নিয়েছিলো। কিন্তু দুঃখ্যের বিষয়, এই লোকটি বিশ্বাসঘাতকতা করে ওকে আওয়ামী বাহিনীর কাছে ধরিয়ে দেয়। তারা কালবিলম্ব না করে তাকে ক্যাম্পাসের প্রান্তেই গুলি করে। খূব মর্মাহত হয়েছিলাম। কারণ লোকটি যেমন ছিল সৎ। তেমনি সুদক্ষ। কোন কাজ-কর্মের ভার দিয়ে বেশী কিছু বলতে হতো না। ডিনার দেবার প্রয়োজন হলে গেস্ট ক’জন থাকবে এবং মেনু কি হবে তার একটা আইডিয়া দিলে সে সুষ্ঠভাবে সবকিছুর আঞ্জাম করতে পারতো। 

রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচার্রী আরো কয়েকজন অবাংগালী ছিল। ভাইস চান্সেলরের প্রধান ড্রাইভারও ছিল বিহারী। লোকটি এককালে আর্মিতে কাজ করেছে। ইংরেজী বলতে পারতো এবং পবিত্র কোরানও হেফজ করেছিল। গন্ডগোলের সময় তাকে নিয়ে খুব -একটা অসুবিধে হয়নি। সে নিরাপদ কোন জায়গায় আশ্রয় নেয়। যতো অসুবিধা বাধেঁ আর এক ড্রাইভারকে নিয়ে; তার নাম জয়নুল আবেদীন। তার মাথার চুল ছিলো সোনালী সুতরাং চিনতে কোনো অসুবিধে হতো না। একদিন সে এসে আবেদন করলো যে সপরিবারে তাকে মেরে ফেলবার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমার বাসায় জায়গা না দিলে রক্ষা নেই। চাপরাশি কোয়ার্টারে এক কামরায় তাকে জায়গা দেওয়া হলো। বললাম যে দিনের বেলায় সে যেন দরজা-জানালা বন্ধ করে একেবারে চুপ করে থাকে। আর ঐ কোয়ার্টারে অন্য যারা ছিল তাদেরও বললাম তারা যেন জয়নাল আবেদীনের সন্ধান কাইকে না দেয়। ওরা কোন বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। কিন্তু একদিন এক বাংগালী গার্ড এসে খবর দিলো যে কোয়ার্টারের চারদিকে জয়নাল আবেদীনের খোজ হচ্ছে এবং তারা তার জীবন রক্ষা করতে পারবে কিনা সে সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠেছে। আমি পরামর্শ দিলাম যে জয়নাল আবেদীন যেনো মাথার চুল কামিয়ে ফেলে এবং আরো বললাম যে দরকার হলে হাজার হাজার লোক যারা পদ্মা পার হয়ে ইন্ডিয়া যাচ্ছিলো তাদের সঙ্গে ওকে পার করে দেওয়া হবে। মাথা সে কামিয়েছিলো তবে অন্য কোথায়ও যেতে রাজী হয়নি। বলেছিলো নসিবে যা আছে তাই হবে, আমি এখানেই থাকব। সুখের বিযয় অন্যান্য গার্ড এবং চাপরাশির সহযোগিতায় তাকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। 

ক্যাম্পাস ত্যাগের প্রস্তাব
১০-১১ এপ্রিলের দিকে পরিস্থিতির যখন আরো অবনতি ঘটলো তখন একদিন ডঃ লুৎফর রহমান, যিনি রাজশাহী গভঃ কলেজের ফিজিক্স এর অধ্যাপক ছিলেন- এসে বললেন, আমরা ঢাকায় চলে যাবার কথা ভাববো কিনা? কারণ এখানে আহার্যেরও অভাব ক্রমশঃ প্রকট হয়ে উঠছে। আমি বললাম যে, আমি দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত সেইকথা বিবেচনা করলে কোন কারণেই- আমার পক্ষে স্থান ত্যাগ করা উচিৎ হবে বলে মনে করি না। তবু একবার বললাম যে বর্তমানে যখন রেল-বাস সবই বন্ধ তখন নৌকা যোগে ঢাকায় যেতে হলে খরচ-পত্র কেমন লাগবে তার খোজ তিনি করতে পারেন। তার দু’দিন পর তিনি এসে খবর দিলেন যে আমাদের দুই পরিবারের সব লোকজন সহ ঢাকায় যেতে দু’টো বড় নৌকার দরকার হবে এবং এরা প্রত্যেকটা নৌকার জন্য ছয়শ’ টাকা করে ভাড়া দাবী করছে। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম যে এই অবস্থায় আমাদের কারো পক্ষেই নৌকাযাত্রা শুভ হবে না। একেতো আমার নিজের দায়িত্বের কথা আছে তার উপর মাঝ পথে সুযোগ পেয়ে মাঝিরাই যে আমাদের মেরে কেটে টাকা পয়সা নিয়ে চম্পট দেবে না তার নিশ্চয়তা কি? ডঃ লুৎফর রহমান আমার এ যুক্তি মেনে নিলেন এবং নিজেও শেষ পর্যন্ত ক্যাম্পাসে রয়ে গেলেন। এ সময় আমরা প্রায়ই শুনতাম যে ঢাকা থেকে আর্মির একদল রাজশাহীর দিকে আসছে। নানা গুজবে ক্যাম্পাস মুখরিত হয়ে উঠেছিলো। প্রতিদিনই বিভিন্নক্ষণে বিভিন্ন রকমের গুজব কানে আসতো।

গাড়ী হাইজ্যাক
একদিন সন্ধ্যার পর সোসিওলজি ডিপার্টমেন্টের এক তরুণ শিক্ষক যিনি আওয়ামী লীগ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন, এসে হাজির। হাতে তার রাইফেল। দাবী করলেন আমার সরকারী গাড়ীটি ছেড়ে দিতে হবে। ভাইস চান্সেলরের দুইটি গাড়ী ছিলো। ছোট গাড়ীটা কয়েক দিন আগেই এই বাহিনীর হাতে হারিয়ে ছিলাম। তারা রাস্তা থেকে ওটা পাকড়াও করে ওটা নিয়ে যায়। এরপর একটি গাড়ীর উপর নির্ভর করেই চলাফেরা করতাম। আমি আপত্তি করা মাত্র যুবকটি বললো যে যদি আমরা হেরে যাই এবং পাকিস্তান আর্মি আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আপনি তাদের বলতে পারেন বন্দুকের মুখে গাড়ী ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। সে আর অনুমতির অপেক্ষায় না থেকে গাড়ীটি চালিয়ে নিয়ে গেলো। শুনেছি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই শিক্ষক কানাডায় চলে যানএবং সেখানেই নাকি বসবাস করছেন।

আমার নিজের পরিবারের সবাই আমার সঙ্গে রাজশাহীতে ছিলো। শুধু সদ্য বিবাহিত মোহসেনা, আমার বড় মেয়ে- ছিল ঢাকায়, পঁচিশ মার্চের পর ঢাকার সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। প্রতিদিন অনেক আজগুবি খবর শুনে চমকে উঠতাম। কারণ আমার আত্মীয়-স্বজন সবাই ছিলেন ঢাকায়। একদিন এক চাপরাশি এসে বললো যে ঢাকা থেকে আগত এক ব্যক্তি খবর দিয়েছে যে পুরনো ঢাকায় বাড়ী-ঘর আস্ত আর নেই। আমাদের নাজিমুদ্দিন রোডের বাসা থেকে নাকি সদর ঘাট পরিস্কার দেখা যায়। যদি এখবর সত্য হয়ে থাকে তাহলে আমার বাসা ‘জোহরা মঞ্জিল’ ও রাস্তার অপর পাশের ‘হাসিনা মঞ্জিল’- যেখামে আমার আত্মীয়-স্বজন অনেকে ছিলেন, দু’টো বাসাই নিশ্চয় ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে। বাসায় যারা ছিলেন তারা বেঁচে আছেন কিনা তাও কেউ বলতে পারছিলোনা। রাজশাহী থেকে কাউকে যে পাঠাবো তারও উপায় ছিলোনা, কারণ পথঘাট সব ছিলো বন্ধ। দু’একজন যারা পায়ে হেঁটে রাজশাহীতে আসতো তারা কোনো ঘটনার সঠিক বিবরণ দিতে পারতো না।

একদিন আমার প্রাইভেট ড্রাইভার প্রস্তাব দিলো সে পায়ে হেটেঁ ঢাকায় যাবে। তার অবস্থাও আমার মত, আত্মীয়-স্বজন সব ঢাকার এলাকায়। সুতরাং বাধা দিলাম না। শুধু বললাম পথের বিপদের কথা। সে বললো কপালে যদি মরণই থাকে তবে তাই হবে। আমি ঢাকায় পৌছতে পারবো। আপনার মেয়ের ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের খবর নিতে চেষ্টা করব। তাকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে এবং ছোট্ট একঢি চিঠি দিয়ে বিদায় দিলাম। পরদিনই বোধ হয় আর এক চাপরাশি, তার নাম ছিলো আশরাফ, এসে বললো, সে আর থাকবে না। সে শুনেছে, পাক বাহিনী ট্যাঙ্ক নিয়ে আসছে। ট্যাঙ্ক সে কখনো দেখেনি, কিন্তু তার ধারণা ওটা এমন এক যন্ত্র যার দ্বারা সামনের বাড়ী-ঘর সব উড়িয়ে দেওয়া যায়। ওকে বললাম, আমরা তো সবাই এখানে আছি তুই একা কোথায় পালাবি? সবাই জানে তুই ইউনিভার্সিটিতে চাকরী করিস। তোকে রাস্তায় পেলেই তো মেরে ফেলবে। আর তোর বাড়ী বরিশাল। বতর্মান অবস্থায় সেখানে তোর পক্ষে যাওয়া সম্ভব হবে না। এ সত্ত্বেও তুই যদি চাস আমি আপত্তি করবো না। লোকটা শেষ পর্যন্ত রয়ে গেলো।

পাকিস্তানি সৈন্যের আগমন
১১-১২ এপ্রিলের দিকে আমরা সঠিক খবর পেলাম যে অনেক পাকিস্তানী সৈন্য আরিচা হয়ে নগরবাড়ী এসে পৌছেছে। তারা মার্চ করে রাজশাহীর দিকে এগুচ্ছে। এ সংবাদে অনেকের মধ্যে ত্রাস বেড়ে গেলো। সারাদিন দেখতাম জিপ নিয়ে বিদ্রোহী ইপিআর ছুটাছুটি করছে। ১১ তারিখ-এ আরো খবর পেলাম যে একদল ইপিআর জিন্নাহ হল দখল করে তার সামনে কামান বসিয়ে রেখেছে। যদি পাকবাহিনী এ পর্যন্ত আসতে পারে, এখানে তাদের বাধা দেওয়া হবে। এ খবর ছিল গুরুতর উদ্বেগজনক। ক্যাম্পাসের কোনো অঞ্চল থেকে পাক বাহিনীর উপর গুলি ছুড়লে ক্যাম্পাস যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে। পরিণতির কথা ভেবে আমরা যারা ক্যাম্পাসে ছিলাম আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম। রেজিস্ট্রার জোয়ারদার সাহেবকে ডেকে অবস্থার কথা বললাম। তিনি বললেন, একমাত্র জেবের মিয়া এই বিপদ খেকে আমাদের উদ্ধার করতে পারে। কারণ সে ইপিআর বাহিনীকে খাদ্য সরবরাহ করতো। জেবের মিয়া ছিলো ইউনিভাসির্টির কন্ট্রাকটর। রাজশাহী ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠার আগে জেবের মিয়া মোষের গাড়ী চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। ইউনিভার্সিটি নির্মাণের কাজ যখন শুরু হয় তখন সে ছোট খাট কন্ট্রাকটরী করতে আরম্ভ করে এবং ক্রমেই উন্নতি লাভ করে প্রথম শ্রেণীর কন্ট্রাকটর হিসেবে ইউনিভার্সিটির অনেক কাজ পেতো। জেবের মিয়াকে খবর দিলাম। সৌভাগ্যক্রমে তাকে পাওয়া গেলো। সে ১০ মিনিটের মধ্যে এসে হাজির হলো। বাসার নীচের তলার অফিসরুমে তাকে নিয়ে আমি আর জোয়ারদার সাহেব বসলাম। অবস্থার বিবরণ দিয়ে বললাম যে ক্যাম্পাস যদি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়, একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। লোকজন তো হতাহত হবেই, বিল্ডিং একটাও টিকবে না। আপনি অবিলম্বে জিন্নাহ হল থেকে ইপিআর বাহিনীকে সরিয়ে ফেলবার ব্যবস্থা করুন। জেবের মিয়া প্রথমে খুব উত্তেজিত স্বরে বললেন, এই স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। আমরা আশা করি এই সংগ্রামে আপনাদের মতো শিক্ষিত ব্যক্তির সহযোগিতা পাবো। আমি উত্তর দিলাম, আপনার সব কথাই মেনে নিচ্ছি। আপনারা হয়তো পাকিস্তান বাহিনীকে পরাস্ত করে স্বাধীন একটি রাষ্ট্র কায়েম করতে সমর্থ হবেন কিন্তু একটা কথা একটু ভেবে-দেখুন, আপনার সাংসারিক উন্নতি যা ঘটেছে সব ইউনিভার্সিটির জন্য। ইউনিভার্সিটি যদি ধুলিস্যাৎ হয়ে যায় নতুন রাষ্ট্রের পক্ষে অবিলম্বে হয়তো নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা সম্ভব হবে না। তখন আপনাদের অবস্থা কি হবে? জেবের মিয়া চুপ রইলেন। মনে হলো আমার এ যুক্তি তার মনে দাগ কেটেছে। একটুভেবে বললেন, আচ্ছা আমি ইপিআর বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করবো। কিন্তু আমাকে দু’দিনের সময় দিতে হবে। আমি বললাম, সে সময় তো আমাদের হাতে নেই। আমরা যা শুনছি তাতে মনে হয় ভবিষ্যতে যাই হোক আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাক বাহিনী রাজশাহীতে পৌছে যাবে। জেবের মিয়া বললেন, আচ্ছা আমি চেষ্টা করছি। ১২ তারিখের রাত্রের মধ্যে ইপিআর বাহিনী ক্যাম্পাস ত্যাগ করে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে দূরে সরে যায়। ১২ই এপ্রিল অবশিষ্ট যে সমস্ত শিক্ষক এবং অফিসার ক্যাম্পাসে ছিলেন তারা ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে শুরু করলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন ডক্টর আবদুর রকিব। তিনি – আমাকে আগে অনেকবার আশ্বাস দিয়েছিলেন যে আর সবাই ক্যাম্পাস ছেড়ে গেলেও তিনি নড়বেন না। কয়েক মাস আগেই তাকে শামসুজ্জোহা হলের প্রভোস্ট নিযুক্ত করেছিলাম।

সোলায়মানের প্রস্তাব
বেলা এগারটার দিকে হঠাৎ আমাদের দর্শন বিভাগের তরুণ লেকচারার সোলায়মান মন্ডল এসে হাজির হলেন। উনিও ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ছিলেন সতেরো মাইল দূরের গ্রামে শ্বশুর বাড়ীঁতে। সাইকেল চালিয়ে এই সতের মাইল পথ অতিক্রম করে এসেছিলেন। তাকে দেখে একটু অবাক হলাম এবং কথা শুনে নির্বাক হয়ে গেলাম। মন্ডল বললেন, স্যার, আমি আপনাকে নিতে এসেছি। ক্যাম্পাসে এ অবস্থায় থাকলে আপনি নিরাপদ হতে পারবেন না। আমি গরুর গাড়ীর ব্যবস্থা করছি। আপনি সপরিবারে চলুন, আমার শ্বশুর অবস্থাপন্ন লোক। আপনার কোন অসুবিধা হবে না। তার সহৃদতায় আমার চোখ প্রায় আর্দ্র হয়ে উঠলো। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম যে, এই সংকটে আমার পক্ষে কোন মতেই ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়া উচিত হবে না। যারা এখনও রয়েছেন তাদের রেখে আমি পালাতে গেলে চিরদিনের জন্য কাপুরুষ বলে চিহ্নিত হয়ে থাকব। তাছাড়া এই গোলমালের মধ্যে গরুর গাড়ীতে করে বের হলে যে ভোগান্তি হবে তার চেয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থান করে বিপদের মোকাবেলা করাই ভাল। জন্ম মৃত্যূ তকদিরের উপর নির্ভর করে। যদি আমার মৃত্যূ অবধারিত হয়ে থাকে, ভাইস চান্সেলরের বাড়ীর কার্পেটের উপর গুলি খেয়ে মরাই আমি পছন্দ করব। সোলায়মান কিছুতেই আমার কথা শুনছিলেন না, অনেক বুঝিয়ে তাকে বিদায় করেছিলাম। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই তরুণটি সেদিন যে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেকথাও ভুলব না।


১৩ই এপ্রিল 
১৩ তারিখের সকাল বেলা থেকে উত্তেজনা চরমে উঠল। একদিকে শুনছিলাম প্রচন্ড গোলাগুলির আওয়াজ অন্যদিকে লোকজন অনবরত নাটোর রোড দিয়ে রাজশাহী শহরের দিকে ছুটে পালাচ্ছিলো। বুঝলাম যে শিগগিরই একটা কিছু হতে চলেছে। বিকেলের দিকে গোলাগুলির শব্দ এমন প্রচন্ড হয়ে উঠলো যে মনে হচ্ছিল যে কোনো মূহুর্তে ভাইস চান্সেলরের বাসায় কামান বা মেশিন গানের গুলি এসে লাগবে। আমাদের আশ্রয় নেবার জায়গা ছিল না। কিছুদিন আগে যখন পাকিস্তান এয়ারফোর্সের বম্বিং শুরু হয় তখন বাসার পিছন দিকে ট্রেঞ্চ বা পরিখা খনন করা হয়েছিল। তার মধ্যে আশ্রয় নিয়েও কোনো ফায়দা হবে না। সন্ধ্যার দিকে আমি এবং ইবনে আহমদ আমাদের পরিবারবর্গকে বললাম, তোমরা এখনই কিছু খেয়ে নাও, সন্ধ্যার পর কি হয় -বোঝা যাচ্ছে না সন্ধ্যা হতেই নীচের তলায় মুখোমুখি দু’টো বাথরুমে দুই ফ্যামিলি আশ্রয় নিলো। এগুলির দেয়াল ছিলো অপেক্ষাকৃত মজবুত, মেশিনগানের গুলিতে ভেঙ্গে পড়ার ভয় ছিলো না। মেয়েদের বাথরুমে চুপ করে বসে থাকবার পরামর্শ দিয়ে আমি এবং ইবনে আহমদ দু’সিঁড়ির সামনে খোলা জায়গাটায় অপেক্ষা করতে লাগলাম। শব্দ শুনে আঁচ করছিলাম দুই পক্ষের মধ্যে সামনের রাস্তায়ই সংগ্রাম চলছে। সেকি প্রচণ্ড শব্দ, বাসার জানালার কাঁচ ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছিলো। দু’একটা বোধ হয় ভেঙ্গেও যাচ্ছিলো শেষ পর্যন্ত আমরা নিজেরাও মেয়েদের সঙ্গে বাথরুমের ভিতর এসে বসে পড়লাম। 

এরকম প্রায় বিশ থেকে ত্রিশ মিনিট চললো। তারপর হঠাৎ সব ঠাণ্ডা। মনে হলো একপক্ষ বিপর্যস্ত হয়ে পালিয়ে গেছে। কিন্তু কারা জিতল বা হারলো কিছুই ঠাহর করতে পারছিলাম না। চারদিকে অন্ধকার। তার উপর মশার কামড়ে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। যখন মনে হলো যুদ্ধ সত্যিই থেমে গেছে তখন আস্তে আস্তে উপর তলায় উঠে ছেলে-মেয়েদের শুয়ে পড়তে উপদেশ দিলাম। আমরা বয়স্করা অর্থাৎ আমি, ইবনে আহমদ ও আমাদের দু’জনার স্ত্রীরা পরবর্তী ঘটনার অপেক্ষায় অন্ধকারে বসে রইলাম। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম কাজলা ও বিনোদপুরের কয়েক জায়গায় আগুন জ্বলছে। আরো বিভ্রান্ত বোধ করলাম। অনেকক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর মনে হলো বাড়ীর গেইট কে যেনো জোর করে খুলে দিয়ে একটা জিপ চালিয়ে ভিতরে ঢুকলো। আমি অত্যন্ত টেন্স হয়ে উঠলাম। নীচে থেকে আওয়াজ এলো, ভাইস চান্সেলর সাহেব বাসায় আছেন? বাংলা কথা, সুতরাং ধরে নিলাম এরা ইপিআর এর লোকই হবে। আমি একটা হারিকেন হাতে নিয়ে নীচে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই মেয়েরা বাধা দিলো। বললো, দরজা খোলামাত্র ওরা হয়তো গুলি করবে। আমি বললাম, দরজা না খুললেও রেহাই পাওয়া যাবে না। ওরা হয়তো দরজা ভেঙ্গে ঢুকবে, তখন তোমাদের উপরও আক্রমণ চলবে। আমি নেমে গেলাম। পেছনে ইবনে আহমদ। দরজায় আমাদের কন্ট্রোলার অব এক্সামিনেশন উমর ফারুক প্রকাণ্ড একঢি জিপ থেকে নেমে বললেন, স্যার আমি এঁদের আপনার বাসায় নিয়ে এসেছি। জিজ্ঞাসা করলাম এরা কারা? উমর ফারুক বললেন, জিপে বসা অফিসারটি পাক বাহিনীর কর্নেল তাজ। কর্ণেল তাজ গাড়ী থেকে না নেমেই আমার সাথে কথা বললেন। ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করলেন, ওরা কোথায়? আমি বললাম, কাদের কথা বলছেন? বললেন, এই যারা পথে আমাকে বাধা দিয়েছিলো। আমি বললাম, ওরা ক্যাম্পাসের কেউ নয়। কর্ণেল তাজ বললেন, মিঃ ভাইস চান্সেলর, আপনি শুনে রাখুন, বিদ্রোহী বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করে আমরা এসেছি। কিন্তু মনে রাখবেন যদি ক্যাম্পাসে কোনো বিল্ডিং থেকে আমাদের উপর গুলি ছোড়া হয়, আপনার ক্যাম্পাসকে আস্ত রাখা হবে না। আমি কাউকে ছাড়বো না। আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, আপনি নিশ্চিত থাকুন ক্যাম্পাসে কোন কিছু হবে না। কর্ণেল তাজ বললেন দেখবো কি হয়! আপনি আমাকে আমার সৈন্যদের রাত কাটাবার জন্য কয়েকটা বিল্ডিং ছেড়ে দিন। 

আমি বললাম, আমাদের প্রায় সব বিল্ডিং খালি পড়ে আছে, আপনি যে কোনো একটা বেছে নিতে পারেন। কর্ণেল তাজ দ্বিরুক্তি না করে উমর ফারুককে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তার পেছনে আরো দু’টি বা একটি জিপ ছিলো। কথাবার্তায় মনে হলো তিনি আমাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেননি। বোধ হয় এই কারণে আমার প্রতি কোন সৌজন্য প্রকাশ করারও প্রয়োজন বোধ করেননি। উমর ফাকক অবশ্য আমার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্ত্বু তাতে, কোন কাজ হয়নি। কর্ণেল তাজ চলে গেলে আমরা উপরে এসে মেয়েদের বললাম যে আগামী কাল বা পরশু কি হবে জানি না তবে আজ রাতে আর কোন গোলাগুলি হবে না। তোমরা নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারো।

(বইটির pdf version download করুন এখানে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>