সমগ্র উপমহাদেশে শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, বুদ্ধিবৃত্তি সর্বক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে ছিল বাঙালী মুসলমানেরা। বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ এসব প্রদেশে মুসলমানদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগের বেশী ছিল না কিন্তু তারা শিক্ষাদীক্ষায় হিন্দুদের চেয়ে অগ্রসর ছিল। বাংলায় মুষ্টিমেয় যে ক’জন লেখাপড়া শিখছিল তাদের পক্ষে প্রতিবেশী হিন্দুদের সাথে প্রতিযোগীতা করে চাকুরিতে ঢুকা সহজ ছিল না। সহজ ছিল না ব্যবসা-বাণিজ্যে সামনে এগুনো। পূর্ব থেকে প্রতিষ্ঠিত অগ্রসর হিন্দুরা তাদের জন্য সামান্যতম স্থানও ছেড়ে দিতে রাজী ছিল না। চিত্তরঞ্জন দাশ একবার চাকুরিতে মুসলমানদের জন্য সংখ্যানুপাতে বরাদ্দের কথা বলেছিলেন, কিন্তু বর্ণহিন্দুরা তার সে প্রস্তাব তৎক্ষনাৎ নাকোচ করে দেয়। আজকের ভারতে আজও তারা দিচ্ছে না। ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা শতকরা ১৫ ভাগ হলে কি হবে, সরকারি চাকুরিতে শতকরা ২ ভাগও তারা নয়। ফলে ভারতের মুসলমানগণ আজ সেদেশের নমশুদ্র বা হরিজনদের থেকেও পশ্চাদপদ। এবং সে ঘোষণাটি এসেছে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কর্তৃক স্থাপিত এক তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে।

অথচ পাকিস্তান সৃষ্টির ফলে পূর্ব বাংলার দরিদ্র কৃষক-সন্তানেরা প্রতিযোগিতমূক্ত বিশাল জায়গা খালী পেয়েছিল সামনে এগুনোর জন্য। বড় গাছের পাশে চারা গাছ বাড়তে পারে না। এ জন্য আলাদা পরিচর্যা দরকার। পূর্ব বাংলার পশ্চাতপদ মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান সে মহাসুযোগটি এনে দেয়। ফলে পাকিস্তান আমলের মাত্র ২৩ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যে সংখ্যক ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, শিক্ষক, উকিল ও অন্যান্য পেশাদার সৃষ্টি হয় ভারতের ১০ কোটি মুসলমান তার সিকিভাগও সৃষ্টি করতে পারেনি। অথচ কি বিস্ময়! আওয়ামী বাকশালী চক্রের কাছে এ সময়টি সবচেয়ে শোষণমূলক যুগ রূপে চিত্রিত হয়। এ সময়টাকে তারা চিত্রিত করে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানী শাসনের যুগ রূপে, যদিও সে শাসকদের মাঝে তাদের নিজ দলের নেতা জনাব সোহরাওয়ার্দ্দীও ছিলেন।

আওয়ামী বাকশালী চক্র এতটাই বিবেকবর্জিত যে, পার্শ্ববর্তী ভারতীয় মুসলমানদের সাথে তুলনামূলক বিচারে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলানেরা যে অনেক খানি দ্রুত এগিয়ে গেল সে কথা তারা বিবেচনায় আনতে রাজী নয়। ভারতে হাজার হাজার মুসলমান যুবক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ডিগ্রি নিয়েও আজ বেকার। সেদেশে মুসলমানদের চাকুরি পাওয়াই কঠিন। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে দাঁড়াতে গেলেই উগ্র হিন্দুদের সন্ত্রাসের কবলে পড়তে হয়। তখন জান নিয়ে বাঁচাই দায় হয়ে যায়। অথচ পাকিস্তানে যোগ দানের ফলে বাঙালী মুসলমানদের ভাগ্য খুলে যায়। এর একটি উদাহরণ দেওয়া যাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. সাজ্জাদ হোসেন সাহেবের স্মৃতীচারণ থেকে। তিনি লিখেছেন,

“হোসেন আলীকে চিনতাম ১৯৪৭ সাল থেকে। ১৯৪৭ সালে আমরা যে কজন তরুণ শিক্ষক পূর্ববঙ্গ অঞ্চল থেকে সিলেটের এম,সি, কলেজে যোগ দিয়েছিলাম হোসেন আলী তাদের অন্যতম। তার ডিগ্রি ছিল কেমিষ্ট্রিতে। সিলেটের আম্বরখানায় আমি যে বাসা ভাড়া করেছিলাম প্রথম কয়েকদিনের জন্য তিনি সেখানে উঠে এসেছিলেন। আমার সঙ্গে আরো ছিলেন ইংরেজীর অধ্যাপক মঈদুল ইসলাম। তিনি বাসায় রয়ে গেলেন। হোসেন আলী এক রিক্সাওয়ালার সাথে মেস করেন। এ সময় অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সেন্ট্রাল সার্ভিসের জন্য অনেক অফিসার রিক্রুট করা হয়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা অনুষ্ঠানের সময় ছিল না কারণ তখনই কিছু লোক ট্রেনিং এর জন্য নিয়াগ করার প্রয়োজন দেখা দিল। এ প্রসঙ্গে বলা বোধ হয় প্রয়োজন যে, পূর্ব পাকিস্তানের বাংগালী আই সি এস অফিসার একজনও ছিল না। সুতরাং শুধু ইন্টারভিউ করে কাউকে ফরেন সার্ভিস, কাউকে এডমিনিসট্রেটিভ সার্ভিস, কাউকে অডিট সার্ভিসে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের কলেজে কলেজে রিক্রুটমেন্ট টিম ঘুরে বেড়িয়ে লোক সংগ্রহ করে। এইভাবে হোসেন আলী পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন।… সেই হোসেন আলী নাটকীয় ভাবে (একাত্তরে) পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করলেন।-(ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন,১৯৯৩)।

উল্লেখ্য, ১৯৭১-এ হোসেন আলী কোলকাতায় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ডিপুটি হাই কমিশনার রূপে অবস্থান করছিলেন। তিনি সে পদ ছেড়ে মুজিব নগর সরকারে যোগ দেন। আওয়ামী সব সময়ই প্রচার চালিয়েছে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে যে বৈষম্য তা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সৃষ্টি। তারা একটি বারের জন্যও বলেনি, এ বৈষম্য বিদ্যমান ছিল ১৯৪৭এ পাকিস্তান সৃষ্টির বহু পূর্ব থেকেই। বাংলার মুসলমানেরা ছিল সমগ্র ভারতে সবচেয়ে পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠি। অথচ ষাটের দশকে এসে তারা করাচী ও লাহোরের সাথে ঢাকার তুলনা করে। কিন্তু ১৯৪৭যে করাচী ও লাহোরের তুলনায় ঢাকার অবস্থাটি আদৌ তুলনা করার মত ছিল। ৪৭-এ ঢাকা ছিল একটি অনুন্নত জেলা শহর। আর করাচী ও লাহোর ছিল বহু বছরের পুরোন রাজধানী শহর। লাহোর বিখ্যাত ছিল মোগল আমল থেকেই। লাহোরের বিখ্যাত বাদশাহী মসজিদ, শালিমার গার্ডেন, বিশাল কেল্লা বা দূর্গ নগরী, সম্রাট আওরোঙ্গজেবের মাজার, নূরজাহানের মাজার- মোগল আমলে এ শহরটি যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সে স্বাক্ষর বহন করে। ১৯৪৭এ লাহোর ও করাচীতে টিনের চালার নীচে সেক্রেটারিয়েটে দফতর খুলতে হয়নি। অথচ আওয়ামী লীগের সমর্থকগণ করাচী ও লাহোরে গিয়েই পাটের গন্ধ আবিস্কার করতো। যেন পশ্চিম পাকিস্তানের শহরগুলো গড়ে উঠেছে পাটের অর্থে। পাকিস্তান হওয়ার আগে কি তারা টিনশেডে অফিস বসাতো? ষাটের দশকে এসে বলা হয় সেনা বাহিনীতে বৈষম্যের কথা। অথচ ১৯৪৭ সালে যে হিমালয় তুল্য বৈষম্য ছিল সে কথা বলে না। এবং সে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। অথচ সে ব্রিটিশ আমলকে দোষারপ না করে আওয়ামী বাকশালী দায়ভার চাপায় পাকিস্তানের উপর। ১৯৪৭-এ মেজর পদমর্যদার উপরে কোন বাঙ্গালী অফিসার ছিল না। সেটিও মাত্র এক জন। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানীদের মধ্যে ছিল জেনারেল। তাদের ছিল বহু ব্রিগেডিয়ার ও কর্ণেল। বলা হয় প্রশাসনে উর্ধতন কর্মকর্তাদের মাঝে বৈষম্যের কথা। অথচ সেটিও ছিল আকাশচুম্বি, ১৯৪৭-এর পূর্ব থেকেই। ৪৭-এ হিন্দু অফিসারদের দেশ ত্যাগের মহা সংকটে পড়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার। রেলগাড়ী চালানোর ড্রাইভারও ছিল না। তখন ভারত থেকে আগত মোহাজির দিয়ে অফিস আদালত, রেল, পোষ্ট অফিসসহ নানা সরকারি দফতর চালাতে হয়েছে। তারা একটি বারের জন্যও এ কথা বলে না, ১৯৪৭এ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে বিশাল বৈষম্য নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ক্রমান্বয়ে কমতে শুরু করেছিল।

১৯৪৭এ অধিকাংশ ডিসি, পুলিশ কর্মকর্তা, রেলকর্মচারী অবাঙ্গালী হলেও ১৯৭০এ চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছিল। প্রায় সবগুলো জেলাতেই তখন বাঙালী অফিসার। এমন কি ১৯৭১এ ইসলামাদে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সেক্রেটারিয়েটে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ কর্মচারিই ছিল পূর্ব পাকিস্তানী। ১৯৭১ ঢাকার পতনের পর যে প্রায় ৪ লক্ষ বাঙালী পশ্চিম পাকিস্তানে আটকা পড়েছিল তারা নিশ্চয়ই সেখানে হকারি বা দিনমুজুরি করত না। তাদের বেশীর ভাগই ছিল সেখানে কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারি বা সামরিক বিভাগের লোক। এমন কি লন্ডন ও নিউয়র্কের পাকিস্তানের দূতাবাদগুলোতে প্রায় অর্ধেক কর্মচারী ছিল বাঙালী। সে চিত্র স্বচক্ষে দেখেছেন ড. সাজ্জাদ হোসেন। তিনি লিখেছেন,

“লন্ডনে যেমন দেখছিলাম দূতাবাসের কর্মচারী প্রায় অর্ধেক বাঙালী, নিউয়র্কে তাই এবং সম্ভবতঃ বাঙালী কর্মচারীদের অনুপাত এখানে আরেকটু বেশী ছিল। –অনেক বাঙালী শিক্ষকও এ্যাডহক এ্যাপয়েন্ট পেয়ে রাতারাতি ডিপলোমেট পদে উন্নীত হন। বার্মায় পাকিস্তানের প্রথম এ্যামবেসেডর ছিলেন বগুড়ার সৈয়দ মোহম্মদ আলী। তিনি পরে ওয়াশিংটনে এ্যামবেসেডর নিযুক্ত হন। (ইনিই পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন।) বার্মায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত যিনি হন তিনি ঢাকার আর্মানিটোলা হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক কমর উদ্দিন আহম্মদ। পরে এই কমর উদ্দিন আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এবং লিখেন, পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের সামাজিক ইতিহাসে ইসলামের বিশেষ স্থান নেই।”- (ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, ১৯৯৩)

বৃটিশ শাসনের ১৯০ বছরে পূর্ব বাংলায় আন্তর্জাতিক মানের কোন বড় শহরই ছিল না। ছিল কিছু মফস্বলের জেলা শহর। একটি জুটমিলও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ৪টি বস্ত্রকল ছিল। সেগুলো হল ঢাকা জেলার চিত্তরঞ্জন কটন মিলস, লক্ষীনারায়ন কটন মিলস, ঢাকেশ্বরী কটন মিলস এবং কুষ্টিয়ার মোহিনী মিলস। ছিল ৪টি চিনি কল। এগুলো হল, কুষ্টিয়া জেলার দর্শনার কেরু কোম্পানী, রাজশাহী জেলার গোপালপুরের উত্তরবঙ্গ সুগার মিলস, রংপুরের মহিমগঞ্জ সুগার মিলস এবং সেতাবগঞ্জের ইষ্টবেঙ্গল সুগার মিলস। সবে ধন নীলমণি এই ক’টি মাত্র মিল ছাড়া এ অঞ্চলে আর কোন শিল্পকারখানাই ছিল না। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে মাত্র ২৩ বছরে এ এলাকায় ৭৬টি জুট মিল প্রতিষ্ঠিত হয়। আদমজী জুটমিল ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাটকল। কাপড়ের কল প্রতিষ্ঠিত হয় ৫৯টি। এগুলোর সাথে প্রতিষ্ঠিত করা হয় অনেক গুলো ইস্পাত কারখানা, ঔষধের কারখানা, রাসায়নিক শিল্প ও চামড়া ও জুতার কারখানা। ..১৯৭০ সালে যে শিল্পোৎপাদন ছিল সেটি বাংলাদেশ আমলে ১৯৮০ সালেও অর্জিত হয়নি। -(এস. মুজিবুল্লাহ, ইত্তেফাক ৩/০৯/৮০)।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সাথে তুলনা করলে শিল্পোন্নয়নের এ হার অন্যদের চেয়ে খুব একটা খারাপ ছিল না। বরং কোরিয়ার মত দেশের সাথে তখন পাল্লা দিয়ে এগুচ্ছিল পাকিস্তান। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর শিল্প খাতে উন্নয়নের স্থলে এসেছে প্রচন্ড ধ্বস। আদমজী জুটমিলসহ বহু বড় বড় মিল ধ্বংস হয়ে গেছে। মোহিনী মিলসহ বহু কাপড়ের মিলগুলিতে লেগেছে তালা। ১৯৪৭-এর আগে ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনে পূর্ব পাকিস্তানী এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মাত্র একটি। সেটি ঢাকায় এবং অতি ছোট আকারের। ছিল না কোন সামুদ্রিক বন্দর। ছিল না কোন মেডিকেল কলেজ, কৃষি ও ইঞ্জিনীয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়। ছিল না কোন আলিয়া মাদ্রাসা। ছিল না কোন উন্নত মানের ক্যান্টনমেন্ট। পাকিস্তান আমলের মাত্র ২০ বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৭টি বিশাল আকারের বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ একাত্তরের পর, বাংলাদেশের বিগত ৩৭ বছরের ইতিহাসে সে মাপের বিশ্বাবিদ্যালয় একটিও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। যা হয়েছে অতি ছোট মাপের; খুলনা, কুষ্টিয়া ও সিলেটে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি তার উদাহরণ। পাকিস্তান আমলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক মানের বিশাল আকারের ৭টি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠিত হয় বড় বড় ক্যাডেট কলেজ ও রেসিডেনশিয়াল মডেল স্কুল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অনেকগুলি ক্যান্টনমেন্ট। নির্মিত হয়েছে দুটি সামুদ্রিক বন্দর। ঢাকা শহরে কোন বড় আকারের বিল্ডিং ছিল না। ছিল না কোন আন্তর্জাতিক মানের হোটেল। বড় আকারের কোন মসজিদও ছিল না। জাতীয় সংসদ, কমলাপুর স্টেশন, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, শাহবাগ হোটেল, শেরাটন হোটেল, হাইকোর্ট বিল্ডিংসহ শহরের বড় বড় এমারতগুলো গড়ে উঠেছিল পাকিস্তান আমলেই। অথচ করাচী, লাহোর, এমনকি পেশাওয়ারও ছিল ১৯৪৭ সালের পূর্ব থেকেই ছিল প্রাদেশিক রাজধানি। পাঞ্জাব ও করাচী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের যে বৈষম্য ছিল সেটি পাকিস্তান আমলের সৃষ্ট ছিল নয়-এ কথা বলার জন্য কি তাই গবেষণার প্রয়োজন আছে? সে বৈষম্য ছিল বহু শত বছরের পুরনো। অথচ আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা এ বৈষম্যের জন্য ষোল আনা দায়ী করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে। তবে সে সত্য তারা নিজেরা না বললে কি হবে, সেটি বেরিয়ে এসেছে এমনকি বহু ভারতীয় হিন্দু সাংবাদিকের মুখ থেকে। সে উদাহরণ দেওয়া যাক। একাত্তরের পর আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরি ঢাকা থেকে নব্য প্রকাশিত “দৈনিক জনপদ” নামের একটি পত্রিকায় কলাম লিখতেন। তিনি লিখেছিলেন,

১৯৭১এর ১৬ই ডিসেম্বরের পর কোলকাতা থেকে কিছু সাংবাদিককে হেলিকপ্টারে তাড়াহুড়া করে ঢাকায় পাঠানো হয়। কয়েকজন ভারতীয় সাংবাদিকের সাথে আব্দুল গাফ্‌ফার চৌধুরিও ছিলেন। তাঁর সাথের ভারতীয় সাংবাদিকগণ ঢাকায় নেমে অবাক। তারা আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরি জিজ্ঞেস করেছিলেন,

“দাদা, আপনি আপনাদের কোলকাতাকে দেখেছেন। কোলকাতায় যা কিছু গড়া হয়েছে সেগুলি ১৯৪৭ এর আগে। ১৯৪৭ য়ের পর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার খুব কমই যোগ করেছে। আপনাদের ঢাকায় তো অনেক কিছু হয়েছে। এরপরও আপনারা কেন স্বাধীন হলেন?”

অধ্যাপক আবু জাফর লিখেছেনঃ

“দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন শুরু হল আমি কোলকাতা চলে যাই।.. আমরা গেলাম কোলকাতা বেতারে। দেবদুলাল বন্দোপ্যাধ্যায়ের সঙ্গে আমার অনেকদিন থেকে পত্র-যোগাযোগ ছিল। .. বেতার থেকে বিদায় নিয়ে গেলাম কবি বুদ্ধদেব বসুর বাসাতে। .. বুদ্ধদেব এবং প্রতিভা বসু দু’জনার কাছে আমরা আশাতীত ভাবে সমাদৃত ও আপ্যায়ীত হলাম। ..বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের আগ্রহ ও কৌতূহল খুব স্বাভাবিক কারণেই সীমাহীন। আর আমরা এরকম দু’জন উন্মুখ ও উৎসাহী শ্রোতা পেয়ে আমরা দুইজন সহযাত্রী অবিরল ভাবে স্বাধীনতা-যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে চলেছি। কিন্তু হঠাৎ একটু ছন্দপতন ঘটলো। কথার ফাঁকে বুদ্ধদেব বললেন, কী এমন হল যে তোমরা হঠাৎ পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চাইছো। তোমাদের কত দিকে কত উন্নতি হচ্ছিল, ভালোই তো ছিলে। আমরাও তে দিল্লীর অনেক অন্যায়-অবিচারের শিকার, তাই বলে কি আলাদা হয়ে যাবো?- (আমার দেশঃ আমার স্বাধীনতা, পাক্ষিক পালাবদল)।

বাংলাদেশের শিল্পায়নের তিনটি যুগঃ ব্রিটিশ, পাকিস্তানী ও বাংলাদেশী। কথা হল, যদি খোদ শেখ মুজিবকে বা অন্য কোন আওয়ামী লীগ নেতাকে জিজ্ঞেস করা হত, বাংলাদেশের সমগ্র ইতিহাসে কোন আমলে সবচেয়ে বেশী ও সবচেয়ে দ্রুত শিল্পায়ন হয়েছে? যদি এ প্রশ্নও করা হত, কোন আমলে সবচেয়ে বেশী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? সেটি বাংলাদেশী বা ব্রিটিশ আমলে এ কথা বললে তাঁকে কি কেউ মানসিক দিক দিয়ে সুস্থ বলত? অথচ আওয়ামী লীগ মহলটি বাংলাদেশের এ যুগটিকেই চিত্রিত করছে পাঞ্জাবের ঔপনিবেশিক শাসনামল রূপে।

  1. বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রাকৃতিক পরিবেশ এদেশের মানুষকে কখনো সুস্থ ভাবে চিন্তা করে সুদূর প্রসারি পরিকল্পনা করতে শেখায়নি। এই জোয়ার ভাটা আর ৬ সিজন-এর দেশের মানুষগুলো যুক্তি এবং উদাহরনের চেয়ে আবেগকে বেশী অনুভব করে যার পরিণতিতে বাংলাদেশ নামক এই ভূ-খন্ডের মানুষগুলো কখনো তাদের চিন্তা-চেতনায় স্ট্যাবল ছিলো না- আবেগের হাওয়ায় পাল তুলে চলেছে এবং চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>