(বইটির pdf version download করুন এখানে)

পাকিস্তানের ব্যর্থতার জন্য শুধু দেশটির শত্রুরাই দায়ী নয়, দায়ী মিত্র বা শুভাকাঙ্খীরাও। পাকিস্তানপন্থি ও ইসলামপন্থিদের রাজনীতিও কি কম আত্মঘাতি? রোগী অনেক সময় মারা যায় রোগের কারণে নয়, চিকিৎস্যকের ভূল চিকিৎসার কারণে। পাকিস্তানের ক্ষতিটা হয়েছে দুই পক্ষ থেকেই। পাকিস্তানের মূলে সর্ব প্রথম যে কুড়ালটি আঘাত হানে তা হল ভাষা আন্দোলন। আন্দোলন শুরু করে তমুদ্দন মজলিসের মত একটি সংগঠন যা দেশে মুসলিম তাহজিব ও তামুদ্দনের কথা বলে। ইসলামি চেতনার কথাও বলে।কথা হল,আন্দোলনের জন্য দিন-ক্ষণ কি যথার্থ ছিল? শত্রুর ষড়যন্ত্রের শিকার পাকিস্তান তার ক্ষতবিক্ষত-জিন্নাহর ভাষায় পোকায় খাওয়া-দেহ নিয়ে সবে মাত্র যাত্রা শুরু করেছে, তখনও দেশটি নিজের ঘর গুছিয়ে নিতে পারেনি। সমাধান হয়নি দেশের শাসনতান্ত্রিক সমস্যার। ওদিকে মরণ কামড় দিতে ওঁত পেতে বসে ছিল প্রতিবেশী শত্রু রাষ্ট্রটি। আর তখনই শুরু হল এ বিশাল আন্দোলন। রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি গুরুতর, বিশ্বের বহু দেশে এর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বছরের পর বছর ধরে চিন্তাভাবনা হয়। রাজপথ উত্তপ্ত না করে এক উত্তেজনামূক্ত পরিবেশে দেশের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা এ নিয়ে গভীর চিন্তা ভাবনা করেন, নিজেদের মাঝে মতের আদান প্রদানও করেন।

অথচ তমুদ্দন মজলিশ ও তার সেকুলার মিত্ররা এ নিয়ে সময় দিতে রাজী হয়নি।চিন্তাভাবনার চেয়ে তারা রাজপথে গোলযোগ সৃষ্টির পথ বেছে নেয়। গুরুত্ব পায় লাশের রাজনীতি। এবং সে সুযোগও তারা পেয়ে যায়, তৎকালীন সরকারের ভূল পলিসির কারণে। অথচ সংসদে বা আলাপ-আলোচনার টেবিলে সহজেই এ সমস্যার সমাধান বের করা যেত। পাকিস্তান যদি চিহ্নিত শত্রুর সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে, তবে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি কেন নিজেদের মাঝে আলাপ-আলোচনায় সমাধান করা যাবে না? আসলে ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য যে নিছক বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেওয়া ছিল না, বরং তা ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গার লক্ষ্যে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এবং সেটি পরে প্রমাণিতও হয়। ফলে এ আন্দোলনের সাথে অতি সক্রিয় হয়ে পড়ে সেসব বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতা, যারা ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রচন্ড বিরোধীতা করেছিল। বাংলাদেশে সেকুলার পক্ষটির এখন স্বীকার করে,ভাষা আন্দোলন থেকেই পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজের শুরু। অর্থাৎ সে সময়ে পাকিস্তানের শাসকবর্গের যে আশংকা ছিল সেটিই সঠিক ছিল। ভাষা আন্দেলনটি ছিল রুগ্নদেহে খোঁড়ায়ে চলা পাকিস্তানের গায়ে এক প্রচন্ড ধাক্কা যা পরবর্তীতে দেশটির জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।ভাষা আন্দোলনের শুরু তমুদ্দন মজলিসের দ্বারা হলেও তারা সে আন্দোলনের নেতৃত্ব পাকিস্তানের শত্রুদের হাতে তুলে দেয়। মুসলিম উম্মাহর জীবনে ফিতনা তথা গোলযোগ যে মানবহত্যার চেয়েও জঘন্য সেটি আবারো প্রমাণিত হল। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন,

“ওয়াল ফিতনাতু আশাদ্দু মিনাল কাতল” অর্থঃ গোলযোগ হল হত্যার চেয়েও গুরুতর।”–(সুরা বাকারা, আয়াত ১৯১)।

মহান আল্লাহ তাই গোলযোগের নির্মূলে অতি কঠোর হতে বলেছেন, এমনকি গোলযোগ নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বলেছেন। ঘূর্ণিঝড়ে বা মহামারীতে কয়েখ লাখ লোকের মৃত্যু হলেও মুসলিম উম্মাহর এতবড় ক্ষতি হয় না। অথচ ফেতনা বা গোলযোগের মধ্য দিয়ে রচিত হয় একটি দেশের মৃত্যূ। ভূলুন্ঠিত হয় মুসলিম উম্মাহর স্বপ্নসাধ। আর পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সেটিই হয়েছিল। এবং সে গোলযোগ সৃষ্টিতে বরাবরই অতি পারদর্শীতা দেখিয়েছে আওয়ামী-বাকশালী চক্র। ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানে যে আত্মঘাতি রূপ নেয়, ভারতে তেমনটি ঘটেনি। অথচ সে সমস্যাটি আরো জটিল ছিল ভারতে। কিন্তু সেটি নিয়ে সমস্যা দানা বাঁধে আর দেরীতে। ভাষার প্রশ্নিটি সেদেশে যখন তুমুল আকার ধারণা করে, ভারত তখন তার মেরুদন্ড শক্ত করে নিয়েছে। এবং সেটির সহনশীল উপায়ে একটি সমাধানও বের করে। ভাষা নিয়ে রাজনৈতিক খেলা শুরুর সাথে সাথে সেখানকার নেতারা ভাষা আন্দোলনের নামে স্বাধীনতা-পরবর্তী দূর্বল সরকারকে লাল কার্ড দেখায় নি। দেশ জুড়ে হরতাল ও ধর্মঘটের ন্যায় অরাজকতাও সৃষ্টি করেনি। যেটি পূর্ব পাকিস্তানে হয়েছে। যেন পাকিস্তানে রাষ্ট্র ভাষার বিষয়টি ছাড়া আর কোন জটিল সমস্যাই ছিল না। অথচ দেশে তখন সরকারের ঠিকমত বসার জায়গাই ছিল না। সারা ভারতের জনগণ হিন্দিকে রাষ্ট্র ভাষা রূপে মেনে নেয়। মেনে নিয়েছে পশ্চিম বাংলার বাঙালীরাও। মেনে নিয়েছে দক্ষিণ ভারতের লোকেরা। অথচ এ ভাষার সাথে দক্ষিণ ভারতের লোকদের সম্পর্ক নাই বল্লেই চলে। প্রথমে তারা হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা রূপে মেনে নেওয়ার বিরোধীতা করলেও অবশেষে এ নিয়ে কোন লংকা কান্ড বাধায়নি, যা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঘটেছে। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে এটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এটি ছিল ভারতীয় ছাত্র-জনতা-বুদ্ধিজীবীর অতি ঐতিহাসিক বিচক্ষনতা, যা পাকিস্তানের কপালে জোটেনি। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে এটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সঠিক সিদ্ধান্ত। নইলে ভাষার সমস্যা নিয়ে যেমন পাকিস্তান ভেঙ্গে গেল সেটি ভারতের কপালেও হতে পারত। অনরূপ এক বিচাক্ষনতাই উত্তর আমেরিকায় জন্ম দিয়েছে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের যা আজ বিশ্বের একমাত্র বিশ্ব শক্তি। অথচ সেখানে অনেক গর্বিত জনগণের বাস। জার্মান, ফ্রেঞ্চ, ডাচ, স্পেনীশসহ নানা ভাষাভাষির গর্বিত মানুষ তাদের নিজ নিজ ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবী ছেড়ে ইংরাজীকে রাষ্ট্র ভাষা রূপে গ্রহন করে। অথচ প্রত্যেকটি ভাষারই রাষ্ট্র ভাষার হওয়ার যোগ্যতা ছিল। এতে তাদের নিজেদের ভাষা যে মারা গেছে তা নয়।

আজও পাকিস্তানের প্রায় ষাট ভাগ মানুষের ভাষা পাঞ্জাবী। কিন্তু সংখ্যার জোরে যদি পাঞ্জাবীকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা রূপে চাপিয়ে দেওয়া হত তবে আজকের অবিশিষ্ট পাকিস্তানও কি টিকে থাকত? তখন সিন্ধি, পাঠান ও বেলুচরা কি সেটি মেনে নিত? পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার মধ্য দিয়েই সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাবীদের কল্যাণ, দেশটির ভাঙ্গার মধ্যে দিযে নয়। অথচ বাঙালীদের মনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার গর্ব এতটাই প্রবল ছিল যে সে আমলে অনেক বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ উর্দুর বদলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীর ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার দাবী তুলেছেন। এবং ভাষার গর্ব নিয়ে অবশেষে তারা পাকিস্তানকেই ভেঙ্গে ফেলল। ভাষার ইতিহাসে অতি প্রাচীনতম ঐতিহ্যের দেশ হল মিশর, এ ক্ষেত্রে তারা ইরানের চেয়েও ছিল অগ্রসর। কিন্তু নিজ ভাষাকে ছেড়ে আরবীকে গ্রহন করায় তারা আজ বিশাল আরব বিশ্বের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতা। কিন্তু ভাষার গর্ব নিয়ে থাকায় ইরানীরা আজ সমগ্র মুসলিম জগত থেকে বিচ্ছিন্ন। ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হল, এ আন্দোলনের নামে প্রচুর মিথ্যাচার হয়েছে। দেশ জুড়ে প্রচুর ঘৃণা ও বিষ ছিটানো হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানীদের মাঝে রটিয়ে দেওয়া হল পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালীর মায়ের ভাষা ও মুখের ভাষাকে কেড়ে নিতে চায়। যেন উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হওয়ার কারণে পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান ও বেলুচদের মায়ের ভাষাকে তাদের মুখ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যেন ভারতের রাষ্ট্র ভাষা হিন্দি হওয়ার কারনে বাংলা ভাষা পশ্চিম বাংলায় আবর্জনার স্তুপে গিয়ে পড়েছে। অথচ এ কথা বলা হল না যে পশ্চিম পাকিস্তানের উপর এ অভিযোগ চাপানো হচ্ছে তাদেরও মাতৃভাষা উর্দু নয়। এরূপ নিরেট মিথ্যা নিয়ে বাংলায় কত গান, কত কবিতা, কত ছড়া ও গল্প লেখা হল। তৈরী হল সিনেমা। এত বিষ, এত ঘৃণা ও এত মিথ্যাচার নিয়ে একটি জাতি কি এক সুস্থ্য থাকতে পারে? এর পরিণাম কি পরস্পরের ভূল বুঝাবুঝি ও বিভেদ নয়? এরূপ ঘৃণা ও বিদ্বেষের জোয়ারে ভেসে যায় বাঙালী-অবাঙালী মুসলমানের মাঝে পারস্পরিক ভ্রাতৃসুলভ শ্রদ্ধাবোধ ও ভালবাসা। দেওয়ালের সিমেন্ট খসে পড়লে দেওয়াল ভাঙ্গতে কি মেহনতের প্রয়োজন পড়ে? জনগণের মাঝে তেমনি পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ বিলুপ্ত হলে সে দেশ ভাঙ্গতে কি বেগ পেতে হয়? ভাষা আন্দোলন সে কাজটিই করেছে।

একটি দেশের বু্দ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাদের মূল দায়িত্ব হল, জনগণের মাঝে সিমেন্ট লাগানোর কাজ করা। একতা সৃষ্টির এমন কাজ ইসলামে পবিত্র ইবাদত। এবং বিভেদ সৃষ্টির যে কোন কাজই হারাম। অথচ ভাষা আন্দোলনের নামে বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল সিমেন্ট সরানোর কাজে। ভাষা শুধু এ নয় যে, সে ভাষায় কেবল কথা বলা হবে। সাইনবোর্ড, রায় বা দলিল লেখা হবে। বরং প্রতিটি ভাষাকে এর চেয়ে আরো অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। নইলে সে ভাষার লোকদের ব্যর্থতা ও বিশ্বজুড়া অপমানের সীমা থাকে না।সে ব্যর্থতা মানুষ রূপে বেড়ে উঠায়। ভাষার সে বাড়তি ও অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হল, জনগণের মনে পুষ্টি জোগানো। সভ্যতর ভাবে বাঁচবার লক্ষ্যে উচ্চতর দর্শন জোগানো। জাতিতে জাতিতে মন ও মননে যে দারুন তারতম্য সৃষ্টি হয় তা তো এ জীবন দর্শনের কারণেই। নবীজী (সাঃ) আরবের মানুষের খাদ্যতালিকা বা পোষাক-পরিচ্ছদে কোন পরিবর্তন আনেননি। তাঁর আগমনে আরবের আবহাওয়া বা জলবায়ু্তেও কোন পরিবর্তন আসেনি। পরিবর্তন এনেছিলেন তাদের জীবন দর্শনে বা বাঁচবার ফিলোসফিতে। আর এতেই আরবদের ইতিহাস পাল্টে গেল। সে মরুভূমিতে জন্ম নিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ। কারণ, সভ্যতা নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সে মূল উপাদান তথা ফিলোসফিটি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। এবং সে জীবন দর্শনটি ছিল ইসলাম। ভাতে-মাছে ও ফলে-মূলে একটি জাতির দৈহিক ভাবে বাঁচাটি নিশ্চিত হলেও সে বাঁচার মধ্য দিয়ে সভ্যতা নির্মিত হয় না। উচ্চতর সংস্কৃতিও গড়ে উঠেনা। পাপুয়া নিউগিনির আদিবাসীদের অনেকেই দৈহিক বলে ইউরোপীয়দের চেয়েও শক্তিশালী। কারণ, সে দেশের বনে জঙ্গলে ফলমূল ও শিকারযোগ্য জন্তুর এখনও অভাব পড়েনি। কিন্তু মনের পুষ্টিতে তাদের দৈন্যদশা এতটাই প্রবল যে, এখনও রয়ে গেছে প্রাচীন প্রস্তর যুগে। তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিগত হাজার হাজার বছরেও সামনে এগুয়নি।

একটি জাতির দৈহিক মান বুঝা যায় তাদের খাদ্য তালিকা দেখে, আর সভ্যতার মান বুঝা যায় ঘরের বই বা পাঠ্য তালিকা দেখে। পাঠ্যতালিকায় মহাজ্ঞানী আল্লাহর গ্রন্থ আল-কোরআন স্থান পেলে সভ্যতা যে মান নিয়ে বেড়ে উঠে সেটি কি পুথিঁ-পাঠে আর কবিতা বা গানের চর্চায় সম্ভব? ইসলামের আগমনে বিপ্লব এসেছিল আরবদের পাঠ্য তালিকায়। “হে বিধাতা, সাত কোটি প্রাণীরে রেখেছো বাঙালী করে, মানুষ করনি।” –রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালীর ব্যর্থতা নিয়ে যে খেদাক্তি করেছেন, সেটি বাঙালীর শারীরীক ভাবে বেড়ে উঠায় ব্যর্থতার কারণে নয়। সে আফসোস, মন ও মননে বেড়ে উঠার ব্যর্থতার কারণে। দ্রুত সভ্যরূপে বেড়ে হওয়ার গরজেই মিশরীয়রা তাদের পাঠ্যতালিকা থেকে তাদের নিজ দেশের প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্য ও ভাষা বাদ দিয়ে কোরআন ও তার ভাষাকে গ্রহণ করেছিল। এজন্য তাদেরকে কেউ বাধ্যও করেনি। অথচ তারা পিরামিড নির্মাণ, কাগজ আবিস্কার, উন্নত বস্ত্র নির্মাণ, ভাষার বর্ণ ও লিখন রীতি আবিস্কারে বিশ্বের অধিকাংশ জাতি থেকে বহু হাজার বছর এগিয়ে ছিল। একই পথ ধরেছিল সিরিয়ান, ইরাকী, আলজিরিয়ান, মরোক্কান, লিবিয়ান ও সূদানীরাও। পাকিস্তানের পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধি ও বেলুচরা উর্দুকে গ্রহণ করেছে তো একই কারণে। কারণ উর্দু ভাষা গড়ে উঠেছিল বহু শত বছর ধরে সমগ্র উপমহাদেশের মুসলমানদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। এ ভাষাটির উন্নয়নে হাজার হাজার বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও আলেম শতাধিক বছর ধরে কাজ করেছে। এজন্যই আরবী ভাষার পরেই ইসলামী জ্ঞানের দিক দিয়ে উর্দুর স্থান। কিন্তু বাংলা ভাষায় সে কাজটি হয়নি। পাকিস্তান যখন প্রতিষ্ঠা হয় তখন বাংলা ভাষায় কোন তফসির গ্রন্থই ছিল না। অনূদিত হয়নি কোন হাদীস গ্রন্থ। রচিত হয়নি মানসম্মত নবীজী(সাঃ)র জীবনী-গ্রন্থ। ইসলামী সাহিত্য বলতে যা বুঝাতো তা হল মীর মোশাররফ হোসেন রচিত বিষাদ সিন্ধু ও কিছু পুঁথি সাহিত্য। কোরআন চর্চা বলতে যা হত, তা মূলতঃ অর্থ না বুঝে তেলাওয়াত। এ দিয়ে কি একটি জাতি ইসলামি চেতনা পায়? পায় কি মনের পুষ্টি?

বাংলা সাহিত্য মূলতঃ গড়ে উঠেছিল হিন্দু সাহিত্যিকদের দ্বারা। মুসলমানদেরকে তারা বাঙালী রূপেও গণ্য করত না। যেমন শরৎ চন্দ্র চট্টপাধ্যায় লিখেছেন, ‌“আমাদের স্কুলে আজ বাঙালী ও মুসলমানদের মাঝে খেলা”। তাঁর এই একটি মাত্র বাক্যেই ফুটে উঠেছে সে আমলে বাঙালী রূপে কাদেরকে বুঝানো হত তার এক বাস্তব চিত্র। হিন্দু সাহিত্যিকদের রচিত বই পড়ে নিছক বাঙালী রূপে বেড়ে উঠা যায়, কিন্তু তা দিয়ে পাকিস্তান বাঁচে না, মুসলমান রূপে বেড়ে উঠার কাজটিও হয় না। এ বিষয়টি অন্ততঃ সেদিন কিছু বিচক্ষণ ব্যক্তি বুঝেছিলেন। উর্দুকে তারাই রাষ্ট্র ভাষা বানাতে চেয়েছিলেন। তারা সে চিন্তাটি করেছিলেন বাঙ্গলী মুসলমানের মন ও মননকে ইসলামি চেতনায় সমৃদ্ধ করার প্রেরণা থেকে। অথচ হুজুগে-মাতা বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবী ও তরুনেরা তাদের সে সদ্দিচ্ছার গভীরে যাওয়ারই কোন চেষ্টাই করেননি। তারা ভেসে গেছে আবেগের জলে। তাদেরকে তারা চিত্রিত করেছে বাংলা ভাষার শত্রু রূপে। এটি ছিল তাদের নিয়তের উপর হামলা। অপর দিকে যারা শুরু থেকেই পাকিস্তান ও প্যান-ইসলামি চেতনার বিরোধী, তারা এটিকে এক মোক্ষম সুযোগ রূপে গ্রহণ করে। মুসলিম চেতনা একটি উন্নত ভাষা থেকে পুষ্টি পাক সেটি আদৌ তাদের কাম্য ছিল না। প্রবল প্লাবনের পানিতে শুধু শিকড়হীন কচুরিপানাই ভাসে না, ভাসে বহু অগভীর শিকড়ের গাছপালাও। তাই সেদিন সেকুলারিস্টদের সৃষ্ট ভাষা আন্দোলনের প্লাবনে ভেসে গেছেন বহু ইসলামী চেতনার মানুষও। মিশরের মানুষ যদি প্রাচীন ফিরাউনী সাহিত্য ও সে সময়ের ভাষাকে আঁকড়ে ধরে থাকতেন তা হলে কি তারা কোরআনের সান্নিধ্যে আসতে পারতেন? আরবী ভাষা থেকে মিশরীয় যেমন লাভবান হয়েছে তেমনি আরবী ভাষাও লাভবান হয়েছে মিশরীয়দের থেকে। আধুনিক যুগে আরবী ভাষায় বুদ্ধিবৃত্তিক সমৃদ্ধি আনার কাজে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের অধিকাংশই মিশরীয়। একসময় মুসলিম বিশ্বে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব ছিল ইরানীদের হাতে। বড় বড় বিজ্ঞানী ও মনিষীর জন্ম হয়েছিল ইরানে। তাদের অবদানের কথা স্বীকার করতে গিয়ে প্রখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী ইবনে খলদুন লিখেছিলেন, ইসলামের জন্ম আরবে, কিন্তু ইসলামি সভ্যতার জন্ম ইরানে। তখন ইসলামি বিশ্বের সাথে তাদের সংযোগের মাধ্যম ছিল আরবী। ইবনে সিনা, আল রাযী, ফারাবী, তাবারী, গাজ্জালীর ন্যায় ইরানী মনিষীগণের লিখনীর ভাষা ছিল আরবী। ইমাম আল গাজ্জালী একমাত্র কিমিয়ায়ে সা’দাত ছাড়া সমুদয় বই লিখেছেন আরবীতে। ইরানের কবিরাও কবিতা লিখতেন আরবীতে। আরবী ভাষার কারণে ইরানীরাও সে সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি করেছিল। কারণ, তখন আরবী ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাষা। পরবর্তীতে সে সংযোগ ছিন্ন করা হয়। এবং এর কারণ ছিল নিছক রাজনৈতিক। সেটি ছিল আরব ও ইরানীদের মাঝে একটি স্থায়ী দেওযাল খাড়া করার প্রয়োজনে। প্রখ্যাত ইরানী কবি রুদাকী আরবী ভাষায় কবিতা লিখতেন। তিনি ছিলেন সভাকবি। তাকে রাজা নির্দেশ দেন আরবীতে কবিতা না লিখতে। বলা যায়, মুসলিম বিশ্বে ইরানই সর্বপ্রথম জাতিয়তাবাদী দেশ। তাই মুসলিম বিশ্ব থেকে ইরানের আজ যে বিচ্ছিন্নদশা সেটির শুরু আজ নয়, সেদিন থেকেই। বাংলা ভাষা আন্দোলনের নেতারাও তেমনি উর্দু ও উর্দুভাষীদের বিরুদ্ধে একটি দেওয়াল খাড়া করতে চেয়েছিলেন। এবং তাতে তারা সফলও হয়েছেন।

ভাষার কাজ শুধু কথা বলা বা মনের ভাব প্রকাশে সাহায্য করা নয়। তাকে বু্দ্ধিবৃত্তিক,অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক,ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজনও মিটাতে হয়। পশ্চিম বাংলার বাঙালীদের সে প্রয়োজন মিটাতে বাংলার পাশাপাশি হিন্দি এবং ইংরেজীও শিখতে হয়।ইউরোপীয়দেরও শিখতে হয় কয়েকটি ভাষা। বিলেতের স্কুলগুলোতে তাই ইংরেজীর পাশাপাশী ফ্রেঞ্চ, স্পেনীশ, জার্মান, এমনকি উর্দু, আরবী, তুর্কী, হিন্দিসহ আরো অনেক ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে। একই কারণে, বাংলাদেশের আনাচে কাঁনাচেও আজ ইংরাজী মিডিয়াম স্কুল খোলার এত হিড়িক। একই কারণে, লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী সন্তান যারা বিদেশে অবস্থান করছে তারা বাংলা ভুলে বিদেশী ভাষায় রপ্ত হচ্ছে। তাই অখন্ড পাকিস্তানের বাংলার পাশাপাশি উর্দু শেখারও প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তখন যুক্তি দেখানো হয়েছিল, বাঙালী কিশোর মনের এত সামর্থ নেই যে তারা আরেকটি নতুন ভাষা শিখবে। অথচ এ অভিমত আদৌ জ্ঞানভিত্তিক ছিল না, ছিল উর্দুর বিরুদ্ধে বিদ্বেষপ্রসূত। পাকিস্তানপন্থিদের ব্যর্থতা, তারা রাজনীতি করেছেন নিছক ক্ষমতায় যাওয়ার মাধ্যম রূপে। অথচ মুসলমানের রাজনীতি হল আল্লহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার ইবাদত। এটি হল, নেক আমলের বিশাল ক্ষেত্র। অথচ এ ইবাদতকে তারা পরিণত করেছিল নিছক একটি পেশায়। ছিল না দূরদৃষ্টি। রাজনীতির ময়দান তারা যতটা না সরগরম করেছেন, ততটা বুদ্ধিবৃত্তির ময়দান নয়। অথচ পাকিস্তান ছিল একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের ফসল।

দেশের জনগণকে দৈহিক ভাবে বাঁচিয়ে রাখতে যেমন লক্ষ লক্ষ টন খাদ্য শস্য চাই, তেমনি মনের সুস্থ্যতার লক্ষ্যেও লক্ষ লক্ষ বই চাই। মুসলমানদের মুসলমান রূপে টিকিয়ে রাখতেও প্রচুর বই চাই। ইসলামে জ্ঞানার্জন তাই ফরয করা হয়েছে। কোরআনের আগে আরবী ভাষায় কোন গ্রন্থ ছিল না। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই মুসলিম মনিষিগণ প্রচুর বই লেখেন, গড়ে তুলেন জ্ঞানের বিশাল সমুদ্র। অথচ সে কাজ পাকিস্তানে তেমন হয়নি। যে হারে কল-কারখানা গড়া হয়েছে সে হারে পুস্তকের প্রকাশনা হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানে কিছু কাজ হলেও পূর্ব-পাকিস্তানে সে তুলনায় কিছুই হয়নি। মুসলিম লীগের নেতারা পত্রিকা বের করেছেন, অথচ সে পত্রিকায় লেখালেখি করেছে ইসলাম ও পাকিস্তানের দুষমনেরা। তারা ব্যর্থ হয়েছেন একতার রাজনীতি করতে। একতা অন্যদের কাছে রাজনৈতিক কৌশল, কিন্তু মুসলমানের কাছে এটি ইবাদত। রাজনীতি হল, পরস্পরে আপোষ ও সমঝোতার ভিত্তিতে সরকার পরিচালনার বিজ্ঞান। একতা ও সমঝোতার পথ বেয়েই আসে মহান আল্লাহর রহমত। ১৯৪৭ সালের পূর্বে বাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বিহার, আসাম, সীমান্ত প্রদেশ, উত্তরপ্রদেশসহ সারা ভারতের মুসলমানেরা একতাবদ্ধ হয়েছিল বলেই আল্লাহপাকের রহমত নেমে এসেছিল। আল্লাহর সে রহমতের বরকতেই সৃষ্টি হয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ মুসলিম রাষ্ট্রটি। সমাজতান্ত্রিক চেতনা ছাড়া কোন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাঁচে না। রাজার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছাড়া রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রও বাচেঁ না। তেমনি প্যান-ইসলামিক চেতনা ছাড়া পাকিস্তানের পক্ষে বেঁচে থাকাটিও অসম্ভব ছিল। কিন্তু সে হুশ মুসলিম লীগ নেতাদের ছিল না। যারা এদেশটির প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিল তারা সে অতি গুরত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয়েও যথেষ্ট গাফলতি দেখিয়েছেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল ১৯৪৬ সালের মতই আরেক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। পাকিস্তানের সমর্থকেরা সেটি বুঝতে না পারলেও শত্রুরা সেটি ঠিকই অনুধাবন করেছিল।ফলে এ নির্বাচনে পাকিস্তান বিরোধী সকল সেকুলার দলগুলি একতাবদ্ধ হয়েছিল। এবং আওয়ামী লীগ লড়েছিল সবার পক্ষ থেকে। কিন্তু সেরূপ একতাবদ্ধ হতে পারিনি ইসলামপন্থি দলগুলি। সে দুর্যোগপূর্ণ সময়ে মুসলিম লীগ বিভক্ত থেকেছে তিন টুকরায়। জামায়াতে ইসলামী, নিজামে ইসলামী ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এর মত ইসলামি দলগুলোও একত্রিত হতে পারেনি। সকল পাকিস্তানপন্থি দলগুলো একতাবদ্ধ হলে ৭০এর নির্বাচনের রায় হয়ত ভিন্নতর হত। বরং অনৈক্যের মধ্য দিয়ে তারা পা বাড়িয়েছেন আত্মঘাতের দিকে। এত বিভক্তিতে কি কোন কল্যাণ হয়? নেমে আসে কি আল্লাহর রহমত? আসে নি। বরং যেটি এসেছে সেটি অপমান।

(বইটির pdf version download করুন এখানে)

  1. স্যার এরমক আরো লেখা চাই,,প্লিজ continue রাখবেন।।এরকম লেখা কোথায় পায়না। সব জায়গায় চেতনা বাজদের
    দাপট।আমরা তরুন প্রজন্ম, আমাদের সঠিকটা জানানো আপনাদের দায়িত্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>