কেন এ লেখা?
একটি জনগোষ্ঠীর জীবনে অতিগুরুত্বপূর্ণ হল তার ইতিহাস। ইতিহাস-জ্ঞান একটি জাতিকে দেয় প্রজ্ঞা, দেয় দূরদৃষ্টি, দেয় সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ। যে জাতি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, সে জাতির ভবিষ্যতের পথ চলাটি সঠিক হয় না, সুখেরও হয় না। পদে পদে ভ্রান্তি হয়। বিশ্বাসঘাতকদের বার বার বন্ধু মনে হয়। জাতির জীবনে তখন পলাশি আসে বার বার। তাই শুধু সাহিত্য, বিজ্ঞান, ধর্ম-শাস্ত্র, কৃষি, বাণিজ্য বা চিকিৎসা-বিজ্ঞানের চর্চা বাড়িয়ে একটি জাতির বাঁচা আদৌ সুখের হয় না। এজন্যই ইতিহাস-বিজ্ঞানকে বলা হয় শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান। কিন্তু পাকিস্তানের ২৩ বছরে এবং বাংলাদেশে ইতিহাস-চর্চার সাথে সুবিচার করা হয়নি। গুরুত্বও আরোপ করা হয়নি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেশটিতে অনেকগুলো মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ, ইঞ্জিনীয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বহু হাজার স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটের কলসহ শতাধিক কলকারখানা।

গড়া হয়েছিল বহু শত রাস্তাঘাট। বাংলাদেশের বিগত হাজার বছরের ইতিহাসে জ্ঞানচর্চা ও উন্নয়নকর্ম কখনই এতটা হয়নি যতটা হয়েছিল পাকিস্তানের ২৩ বছরে। তবে সে জ্ঞানচর্চায় ভয়ানক অসম্পন্নতা ছিল এবং সেটি ছিল ইতিহাসের জ্ঞানে। সে অসম্পন্নতায় দেশবাসীর অজানা রয়ে গেছে দেশটির নিজের জন্মের ইতিহাস। ভারত ভেঙ্গে কেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হল, কেন পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ পাশের পশ্চিম বাংলার ন্যায় ভারতে যোগ না দিয়ে হাজার মাইল দূরের পশ্চিম-পাকিস্তানীদের সাথে পাকিস্তানে যোগ দিল –সে প্রেক্ষাপট নিয়ে পাকিস্তানের ২৩ বছরে একখানি বইও লেখা হয়নি। কেন বহু লক্ষ বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে খালি হাতে পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নিল -সে ইতিহাসও লেখা হয়নি। সভ্য-মানুষেরা পাশের বনজঙ্গলে বাস করা পশু-পাখিরও খবর রাখে। কিন্তু প্রতিবেশী হিন্দুস্থানের মুসলমানদের দুরাবস্থার কথা বাংলাদেশের জ্ঞানচর্চায় কোন গুরুত্বই পায়নি। ফলে লেখা হয়নি ভারতীয় মুসলমানদের দুর্দশা নিয়ে একখানি বইও। অন্ধ মানুষকে এমনকি শিশুও বিভ্রান্ত করতে পারে। তেমনি ইতিহাসের জ্ঞানে অজ্ঞ-ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বা মন্ত্রী হলেও তাকে যে কোন শত্রু-রাষ্ট্র কলুর বলদ বানাতে পারে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কলুর বলদের সংখ্যা কি কম?

বাংলাদেশের ইতিহাসে বহু প্রশ্নেরই সঠিক জবাব নেই। আছে প্রচন্ড মিথ্যাচার। সত্তরে নির্বাচন হল, কিন্তু নির্বাচনের পর কি কোন রাজনৈতিক নিষ্পত্তির পথ খোলা ছিল না? ভয়ানক যু্দ্ধকে কি এড়ানো যেত না? পাকিস্তান সরকারের সামরিক এ্যাকশনের বহু আগেই ৭ই মার্চের জনসভায় শেখ মুজিব কেন যুদ্ধের ডাক দিলেন? ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রীত্বের যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সেটি কি মিথ্যা ছিল? তিনিও কি নির্বাচনের আগে ইয়াহিয়া খানকে পাকিস্তানের অখন্ডতা বজায় রাখবেন সে ওয়াদা দেননি? শেখ মুজিব সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রস্তাবটি গ্রহণ না করে কেন শুধু পূর্ব-পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবী জানান? এরূপ নানা প্রশ্ন রয়েছে একাত্তরকে ঘিরে। কিন্তু এসব বিষয় বাংলাদেশের ইতিহাসে যথার্থ আলোচনা হয়নি।

একাত্তরে একটি প্রকান্ড যুদ্ধ ঘটে গেল। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হল। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রটি খন্ডিত হল – এ বিষয়গুলো যে কোন ঈমানদারের চেতনায় প্রচন্ড ঝাকুনি দিবে সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু তাতে ক’জন আন্দোলিত হয়েছে? তাতে ক’জন আঘাত পেয়েছে বাংলাদেশে? গড়ার কাজে নয়, বাংলাদেশের মানুষ ভাঙ্গার কাজকে উৎসবে পরিণত করেছে। ক’জন একাত্তরের সে রক্তাত্ব্ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছে? অতীত বলে বিষয়গুলোকে কি আস্তাকুঁড়ে ফেলা যায়? ইতিহাস কি হাতের ময়লা যে তাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলা হবে? ইতিহাসের নির্মাণে লক্ষ লক্ষ মানুষে রক্ত ব্যয় হয়, এতে বহু লক্ষ মানুষের চোখের পানি ঝরে। রক্তক্ষয়ী পরাজয় আসলেও তাতে অমূল্য অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। ইতিহাসের গুরুত্ব তাই বিজয়ীদের চেয়ে পরাজিতদের কাছে আরো বেশী। কারণ সেখান থেকেই তারা পায় আগামী দিনের বিজয়ের শিক্ষা। কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমান বা ইসলামপন্থিদের মাঝে সবচেয়ে বড় অনাগ্রহ এই ইতিহাস চর্চা নিয়ে। তারা যেমন একাত্তরের পরাজয় থেকে শিক্ষা নেননি, তেমনি সাতচল্লিশের বিজয় থেকেও নয়। ইসলামপন্থি নেতারা তো ১৯৭১য়ের ইতিহাসকে ভূলতে চান। মন থেকে চান, বাংলাদেশের মানুষও সে ইতিহাস ভূলে যাক। এটিও কি কম আহাম্মকি? একাত্তরের পরাজয়ের সে স্মৃতি নিয়ে তারা ভাবতে চান না। এসব নেতারা এখন ভবিষ্যতের কথা বলেন। অথচ অতীতকে বাদ দিয়ে ভবিষ্যতের নির্মাণ কি এতটাই সহজ? এটি এক চরম বিভ্রান্তি। এ বিভ্রান্তি নিয়েই তারা এখন নিজেদের একাত্তরের রাজাকার জীবনের ইতিহাস আস্তাকুঁড়ে ফেলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে উৎসবে নেমেছে এবং দূরে ছুঁড়ে ফেলেছে প্যান-ইসলামিক চেতনা। তারা এখন একাত্ম হতে ব্যস্ত হতে জাতীয়তাবাদী শিবিরে।

বাংলাদেশের ইতিহাসের বহু আলোচিত প্রসঙ্গ হল রাজাকার ও মু্ক্তিযোদ্ধার বিষয়। দু’টি প্রসঙ্গই ছড়িয়ে আছে দেশের ইতিহাস, উপন্যাস, নাটক, কবিতা, রাজনীতিকের বক্তৃতা-বিবৃতিতে ও পত্রিকার পাতায়। তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্রচুর প্রশংসা হলেও রাজাকারদের নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা হয়নি। যা হয়েছে তা নিছক পক্ষপাতদুষ্ট গালিগালাজ। গালিগালাজ কোন দেশেই ভদ্রতার পরিচায়ক নয়, এতে কুৎসিত চরিত্রের পরিচয় মেলে তার যে ব্যক্তি এমন গালিগালাজকে রাজনীতি রূপে গ্রহণ করে। এমন গালিগালাজে রাজাকারদের আসল পরিচয়টি জানা অসম্ভব। অথচ আগামী প্রজন্মের কাছে সে প্রসঙ্গটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। এটি হল আজকের জ্ঞানীদের দায়বদ্ধতা। কিন্তু সে দায়বদ্ধতা আদৌ পালিত হয়নি। কারা এ রাজাকার? কি ছিল তাদের মিশন? কেন তারা বাঙ্গালী হয়েও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় বিরোধীতা করলো এবং রক্ত দিল? কি ছিল তাদের রাজনৈতিক দর্শন? কিসে তারা অনুপ্রাণিত হল? এ প্রশ্নগুলি শুধু আজকে নয়, শত শত বছর পরও বাংলাদেশের ইতিহাসের পাঠকের মনকে আন্দোলিত করবে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে গালিগালাজ ছাড়া তাদের নিয়ে বিশেষ কিছুর উল্লেখ নেই। ফলে সে প্রশ্নের উত্তরলাভে কোন পথই খোলা রাখা হয়নি।

একাত্তরের লড়াইয়ে বিজয়ী হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা। বিজয়ের পর তারা শুধু দেশের রাজনীতির উপরই দখলদারি প্রতিষ্ঠা করেনি, দখলদারি প্রতিষ্ঠা করেছে দেশের ইতিহাস রচনার ন্যায় এ্যাকাডেমিক বিষয়টির উপরও। ফলে রাজাকারদেরও নিজেদের পক্ষে কিছু বলার থাকতে পারে সেটিরও স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আসামীর কাঠগড়ায় অভিযুক্ত অপরাধিকেও আত্মপক্ষ সমর্থনে ইচ্ছামত বলার অনুমতি দেওয়া হয়। দেশের ইতিহাস রচনাতেও সে সুযোগটি রাখতে হয়। বিজয়ী পক্ষের সাথে পরাজিত পক্ষের সঠিক পরিচয়টি দিতে না পারলে ইতিহাস চর্চা অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায়। ইতিহাস তখন পক্ষপাতদুষ্ট হয় এবং বিবেকের আদালতে সেটি গ্রহণযোগ্যতা হারায়। এতে অবিশ্বাস জন্মে সমগ্র ইতিহাসের উপর, তখন পুরা ইতিহাস গিয়ে পড়ে আস্তাকুঁড়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে সেটাই ঘটেছে।

এ লেখাটির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় বাংলাদেশের ইতিহাসে যে গভীর শূন্যতা ও পক্ষপাতদুষ্টতা, কিছুটা হলেও সেটি দূর করার লক্ষ্যে। দেশটির ইতিহাসে রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধা – এ দু’টি শব্দের ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে একে অপরের প্রতিপক্ষ রূপে। উভয় পক্ষই একাত্তরে প্রচুর রক্ত দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা রক্ত দিয়েছে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের সৃষ্টিতে। রাজাকারেরা রক্ত দিয়েছে অখন্ড পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাতে। এটি ছিল রাজনীতির দুটি ভিন্ন ধারা ও দু’টি বিপরীত দর্শনের বিষয়। প্রতিদেশেই রাজনীতি নিয়ে এরূপ নানা মত থাকে, নানা প্রতিপক্ষও থাকে। তাদের মাঝে সে মত ও পথ নিয়ে লড়াইও থাকে। দেশের কল্যাণের বিষয়টি নিয়ে সবাই একই ভাবে না। বিপরীত মুখি নানা ভাবনা যেমন ১৯৭১ সালে ছিল, তেমনি ১৯৪৭ সালেও ছিল। আজ যেমন আছে, তেমনি আজ থেকে শত বছর বা হাজার বছর পরও থাকবে। এর মধ্যে কেউ হারবে এবং কেউ জিতবে। ইতিহাসে কারো বিজয়ই চিরস্থায়ী হয় না। দিনবদলের সাথে সরকারেও পরিবর্তন আসবে। কিন্তু প্রতিটি বিজয়ী পক্ষই যদি নিজেদের পছন্দমত ইতিহাস লেখা শুরু করে তবে তাতে দেশে বহুরকমের ইতিহাস রচিত হবে। বাংলাদেশে তেমন ইতিহাস রচনার কাজটি শুরু করেছে একাত্তরের বিজয়ী পক্ষ তথা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। দলীয় উদ্যোগে ইতিহাস রচনার সাথে তাই গুরুত্ব পেয়েছে বিপক্ষদলীয় নেতাদের গায়ে কালিমা লেপনের কাজ। রাজাকারকে চিত্রিত করেছে যুদ্ধাপরাধি রূপে, আর নিজেদেরেক চিত্রিত করেছে ফেরেশতা রূপে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কোন মানুষ খুন হয়েছে বা অন্য কোন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ইতিহাসে তার বিন্দুমাত্র বিবরণও নেই। হাজার হাজার বিহারী, রাজাকার ও পাকিস্তানপন্থি নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে যেন আসমান থেকে বাজ পড়ায়! তাদের ঘরবাড়ি, ব্যাবসা-বাণিজ্য ও সহায়-সম্পদ লুট হয়েছে যেন দূরের কোন ঝড়ো হাওয়ায়! বাংলাদেশের ইতিহাসে এসব প্রশ্নের কোন উত্তর নাই।

প্রতিটি মানুষের রাজনীতি, কর্ম ও আচরণ পরিচালিত হয় তার চিন্তা-চেতনা ও দর্শন থেকে। এমনকি অতিশয় দুর্বৃত্তও দুর্বৃত্তিতে অনুপ্রেরণা পায় জীবন, জগত ও ন্যায়নীতি নিয়ে তার বিশেষ ধ্যান-ধারণা থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার সে উৎসটি কি? রাজাকারগণই বা কোত্থেকে পেল সে দূর্দিনে জোয়ারের স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানোর? বাংলাদেশের ইতিহাসে সে সবেরও উত্তর নেই। বস্তুত এসব নানা প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়েই এ লেখাটির সূত্রপাত।

কারা রাজাকার এবং কারা মুক্তিযোদ্ধা?
১৯৭১এ বাংলাদেশে দু’টি প্রধান ও প্রবল চেতনা বা দর্শন কাজ করেছিল। একটি হল প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভ্রাতৃত্বের দর্শন- এ থেকেই জন্ম নিয়েছিল রাজাকারের চেতনা। অপরটি ছিল ভাষাভিত্তিক বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদী দর্শন- মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনার মূল উৎস হল এটি। একাত্তরের ঘটনাবলীর যথার্থ বিশ্লেষনে এ দু’টি চেতনাকে অবশ্যই বুঝতে হবে। নইলে বিচারে প্রচন্ড অবিচার হতে বাধ্য। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কর্মে, আচরণে, রুচীবোধে ও রাজনীতিতে যে ব্যাপক পার্থক্য তা তো এই চেতনার পার্থক্যের কারণেই, খাদ্য-পানীয়, শারীরিক বৈশিষ্ট বা জলবায়ুর কারণে নয়। তাই একই রূপ খাদ্যপানীয় ও একই জলবায়ুতে বেড়ে উঠে কেউ রাজাকার হয়েছে এবং কেউ মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। ব্যক্তি ক্ষণজন্মা, কিন্তু চেতনা বেঁচে থাকে শত শত বছর। তাই আজকের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন বেঁচে আছে তেমনি বেঁচে আছে রাজাকারের চেতনাও। এ দু’টি চেতনা ১৯৭১য়ে যেমন ছিল, তেমনি একাত্তরের পূর্বে ১৯৪৭য়েও ছিল। তেমনি বহু শতবছর পরও থাকবে।

চেতনার নির্মাণে যেটি কাজ করে সেটি হল একটি জীবন-দর্শন। আর দর্শন তো বেঁচে থাকে হাজার হাজার বছর ধরে। আর তা যদি হয় ইসলামী দর্শন তবে সেটি তো মৃত্যূহীন। ব্যক্তি তার দর্শন থেকেই কর্মে, ত্যাগে ও প্রাণদানে প্রেরণা পায়। রাজাকারের চেতনায় সে দর্শনটি ছিল পবিত্র কোরআনের। একাত্তরে বাংলা ভাষার নামে যখন পৃথক রাষ্ট্রগড়ার যুদ্ধ হচ্ছিল, সে সময় বহু হাজার বাঙ্গালী যুবক পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় প্রাণ দিয়েছে, জেল খেটেছে ও নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছে। এবং তাদের ত্যাগের পিছনে কাজ করেছিল বিশ্বমুসলিম ভ্রাতৃত্বের দর্শন। এ দর্শন নির্মূল করে দেয় ভাষা, ভূগোল ও বর্ণভেদের প্রাচীর। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের কাছে যেখানে অবাঙ্গালী মাত্রই ছাতুখোর শত্রু এবং ঘৃণার যোগ্য ও হত্যাযোগ্য, রাজাকারদের কাছে সেটি মনে হয়নি। সাতচল্লিশে যেমন মনে হয়নি, তেমনি একাত্তরেও নয়। আজ যে বহু লক্ষ অবাঙ্গালীকে নিজেদের ঘর থেকে বের করে বস্তিতে বসানো হয়েছে, তাদের ঘরবাড়ী, ব্যবসাবাণিজ্য ও সহায়সম্পদ ঢালাও ভাবে ছিনতাই করা হয়েছে -সেটি তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফল। বিশ্বের কোন সভ্যদেশে এর নজির নেই। কোরআনের দর্শনকে সাম্প্রদায়িকতা বলে মুক্তিযোদ্ধারা আল্লাহর প্রদর্শিত পথকে নিজেদের রাজনীতি ও যুদ্ধবিগ্রহে কম্পাস রূপে গ্রহণ করতে পারেনি। অথচ প্রতি কর্মে কোরআনকে অনুসরণ করা প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরজ। কোরআন ব্যক্তিকে ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার উপরে উঠতে নির্দেশ দেয় এবং এসব ক্ষুদ্রতার ভিত্তিতে বিভক্তি গড়া ইসলামে ফৌজদারি অপরাধ। ইসলামের সে বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের কারণেই মুক্তিযোদ্ধদের হাত থেকে অসহায় অবাঙ্গালী পরিবারদের বাঁচাতে সাধ্যমত চেষ্টা করেছে রাজাকারেরা এবং এ চেতনাটি ধারাবাহিকতা পেয়েছিল সাতচল্লিশ থেকেই। সে সময় এ চেতনাটির প্রভাব এতটাই প্রবল ছিল যে, ভারত থেকে তাড়া খাওয়া অবাঙ্গালীদের জন্য ঢাকাসহ পূর্ব-পাকিস্তানের বহুনগরে পরিকল্পিত বাসস্থানের ব্যাবস্থা করা হয়েছিল। তখন বাঁধনটি ছিল ঈমানের; ভাষা, বর্ণ বা ভূগোলের নয়। অসহায় অবাঙ্গালীদেরকে বাঁচানোর কাজটিকে তারা পবিত্র ইবাদত মনে করতো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিদের বড় সাফল্য যে, সাতচল্লিশের সে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের চেতনাকে তারা পরাজিত করেছে। ফলে সাতচল্লিশের যে চেতনায় কায়েদে আজম, আল্লামা ইকবাল, সলিমুল্লাহ, নাযিমুদ্দীন, লিয়াকত আলী খান, আকরম খানরা শ্রদ্ধেয়জন মনে হত, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এখন আর তা মনে হয় না। একাত্তরের রাজাকারদের সাথে তাঁদেরকে তারা একাকার করে দেখে। কারণটি হল, সাতচল্লিশের নেতৃবৃন্দ ও একাত্তরের রাজাকারেরা যে চেতনায় অভিন্ন -সেটি তারা বুঝতে ভূল করেনি। অভিন্ন ছিল তাদের মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ ও রাজনীতি। ফলে একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধরা শুধু রাজাকার হত্যাতেই আনন্দ পায়নি, আনন্দ পেয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে ৪৭-য়ের মুসলিম নেতাদের নাম মুছে ফেলতেও। অন্যদিকে তাদের কাছে অতি আপনজন মনে হয়েছে গান্ধি, নেহেরু, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, চিত্তরঞ্জন সুতোর, ম্যানেক শ’ ও অরোরা। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হল হয়ে গেছে সূর্য সেন হল। অথচ সাতচল্লিশে বাংলার মানুষ যদি কায়েদে আজম, নাযিমুদ্দীন, লিয়াকত আলী খানদের বাদ দিয়ে গান্ধি, নেহেরু, ক্ষুদিরামের পথ ধরতো তবে আজকের বাংলাদেশই হত না। কাশ্মীরের মুসলমানদের মত তখন তাদেরও ফিবছর অসংখ্য দাঙ্গার শিকার হতে হত, এবং মুসলিম রমনীদের ধর্ষিত হতে হত। একটি চেতনা যে শত্রু-মিত্র নির্ণয়ে মানবের মনে কতটা গভীর প্রভাব ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীরা হল তার জ্বলন্ত নমুনা। এ চেতনার ফলেই আল্লাহর আইনের প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে রাজপথে নামা পাশের বাড়ীর বা পাশের গ্রামের দাড়ী-টুপিধারী বাঙ্গালী যুবকটিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিদের কাছে হত্যাযোগ্য মনে হয়। এজন্য তাকে পাঞ্জাবী বা বিহারী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

চেতনা বেঁচে থাকে নতুন প্রজন্মের ধ্যান-ধারণা, কর্ম ও রাজনীতির মাঝে। ফলে ভারতের অর্থ ও অস্ত্রে ভারতীয় সেপাহিদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অখন্ড-পাকিস্তানের সমর্থকদের হত্যার যে চেতনা একাত্তরে পরিচর্যা পেয়েছিল সেটি এখনও বেঁচে আছে। বেঁচে আছে এমনকি একাত্তরের বহু পরে জন্ম নেওয়া তরুন সেকুলারিস্টদের মাঝেও এবং তাদের কারণেই আজও প্রবল ভাবে বেঁচে আছে ভারতের সেবাদাস চরিত্রের রাজনীতি। একই প্রক্রিয়ায় বেঁচে আছে রাজাকারের চেতনাও। আধিপত্যবাদি ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে আজও যে প্রবল প্রতিরোধের লড়াকু জজবা সেটি তো সে অভিন্ন চেতনা থেকেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রকৃত লড়াই মূলতঃ এ দু’টি চেতনার। এটি বহু বাংলাদেশী না বুঝলেও ভারত ষোলআনা বুঝে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেবাদাস চরিত্রটি বাঁচাতে ভারত সরকার ও ভারতভক্ত সেকুলার বাংলাদেশীদের এত কসরৎ। বাংলাদেশের শিল্পে কোন বিণিয়োগ না করলে কি হবে, বহু হাজার কোটি টাকা তারা বিণিয়োগ করেছে এ চেতনা বাঁচাতে। অসংখ্য রাজনৈতিক ও সামাজিক দলকে তারা বাংলাদেশে রাজনীতি ও সংস্কৃতির ময়দানে নামিয়েছে। শত শত পত্র-পত্রিকা, বহু শত এনজিও, বহু টিভি প্রতিষ্ঠান এক যোগে কাজ করছে এ লক্ষ্যে। বাংলাদেশের সীমান্তে মোতায়েনকৃত ভারতীয় সেনাদের চেয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়োজিত এসব এজেন্টদের সংখ্যা এজন্যই কম নয়। বরং ভারতের পক্ষে মূল যুদ্ধটি লড়ছে তো তারাই। এজন্যই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে টিপাই মুখ বাঁধ, ফারাক্কা বাঁধ ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিটের পক্ষে কথা বলতে কোন ভারতীয় লাগে না।

একাত্তরে রাজাকারের চেতনায় যেটি প্রবল ভাবে কাজ করেছিল সেটি হল ভারতীয় ষড়যন্ত্র ও সামরিক আগ্রাসন থেকে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে বাঁচানোর প্রেরণা। বিশ্বশক্তি রূপে মুসলমানদের উত্থানে সাধ্যমত ভূমিকা রাখা। ভারত বিপুল সংখ্যক মানুষকে সেদিন বিভ্রান্ত করতে পারলেও রাজাকারদের বিভ্রান্ত করতে পারিনি। ভারতের মুসলিম বিরোধী ভূমিকাকে তারা ১৯৪৭য়ে যেমন দেখেছে, তেমনি ৪৭য়ের পরেও দেখেছে। মুসলমানদের প্রতি ভারতীয় শাসকচক্রের কুকর্মগুলো তারা নিয়মিত দেখেছে সেদেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বহু সহস্র সহিংস দাঙ্গায়। সে সব দাঙ্গায় উগ্র হিন্দুদের কাছে প্রচন্ড উৎসব গণ্য হয় মুসলিম হত্যা, নারীধর্ষণ ও লুটপাট। এসব দাঙ্গায় ভারতীয় সরকার ও পুলিশের ভূমিকা হয় নীরব দর্শকের। ফলে হাজার হাজার মুসলমান নিহত ও শত শত মুসলিম নারী ধর্ষিত হলেও ভারতীয় পুলিশ কোনবারেই অপরাধী খুঁজে পায়নি। যেন সেদেশে কোন অপরাধই সংঘটিত হয়নি। একইভাবে সরকারি চাকুরিতে মুসলমানদেরকে বঞ্চিত করাটিও সেদেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে একটি স্ট্রাটেজী রূপে প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ফলে ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা শতকরা ১৬ ভাগ হলেও সরকারি চাকুরিতে তাদের সংখ্যা দুই ভাগও নয়।

ভারতের শত্রুতা পাকিস্তানের জন্ম থেকেই। দেশটি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠারই শুধু বিরোধীতা করেনি, জন্মের পর সব সময় চেষ্টা করেছে দেশটিকে সমূলে বিনাশে। সে শত্রুতা যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল তা নয়, ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বিরদ্ধেও। পূর্ব পাকিস্তানকে মরুভূমি করতেই তারা নির্মাণ করেছে ফারাক্কা বাঁধ। ভারতের আগ্রাসী আচরণটি দেখা গেছে কাশ্মিরে, হায়দারাবাদে ও মানভাদরে। দেখা গেছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৪৮ ও ১৯৬৫এর যুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনায় কাজ করেছিল এমন আগ্রাসী ভারতকে সাহায্যকারি বন্ধুরূপে গ্রহণ করার প্রেরণা। কিন্তু রাজাকারেরা এমন চিহ্নিত শত্রুপক্ষকে কখনই বন্ধু রূপে গ্রহণ করতে পারেনি। শত্রু রূপে দেখেছে যেমন সাতচল্লিশে, তেমনি একাত্তরেও। ভারতও যে মুসলমানদের কল্যাণে কিছু করতে পারে সেটি তারা বিশ্বাস করতে পারেনি। কারণ, তেমন কল্যাণে আগ্রহ থাকলে সেটির শুরু হওয়া উচিত ছিল ভারতের মুসলমানদের কল্যাণে কিছু করার মধ্য দিয়ে- একটি প্রকান্ড যুদ্ধ, সে যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ও একটি রাষ্ট্রের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নয়। আর রাজাকারদের ধারণা যে কতটা সত্য সেটি প্রমাণিত হয়েছিল একাত্তরের পর।

একাত্তরে দুই বিরোধী শিবিরেই সেদিন লক্ষ লক্ষ বাংলাভাষী জীবনের ঝুকি নিয়ে রণাঙ্গনে নেমেছিল। অথচ এমন একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কাউকেই কেউ বাধ্য করেনি। উভয় পক্ষই পরিচালিত হয়েছে নিজ নিজ জীবনদর্শন ও চেতনার বল থেকে। মুক্তিযোদ্ধারা যেমন স্বেচ্ছায় ভারতে গেছে এবং তাদের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানের ধ্বংস ও পাকিস্তানীদের নিধনে যুদ্ধে নেমেছে তেমনি লক্ষাধিক বাঙ্গালী যুবকও স্বেচ্ছায় পাকিস্তান বাঁচানোর লড়াইয়ে নেমেছে। রাজাকার শব্দটি একটি ফার্সী শব্দ। ফার্সি থেকে এসেছে উর্দুতে। রাজাকার বলতে তাদেরকে বুঝায় যারা কোন ব্যক্তিস্বার্থে নয়, বরং রাষ্ট্র বা জনগণের কল্যাণে স্বেচ্ছাপ্রনোদিত হয়ে কোন যুদ্ধ বা সমাজ-কল্যাণে অংশ নেয়। একাত্তরে তাদের সে মিশনটি ছিল, ভারতীয় ষড়যন্ত্র ও আগ্রাসন থেকে পাকিস্তানকে বাঁচানোর। পাকিস্তানে অবিচার ছিল, বঞ্চনা ছিল, জুলুমও ছিল। রাজনৈতিক অনাচারও ছিল। তবে সমাধান যে ছিল না তা নয়। দেহের যক্ষা বা ম্যালেরিয়া সারাতেও সময় লাগে। বহু দেশে এমন সমস্যা কয়েক যুগ ধরে চলে। যেমন পাকিস্তানের বয়সের চেয়ে অধিক কাল ধরে চলছে ইংল্যান্ডে আয়ারল্যান্ডের সমস্যা। কয়েক যুগ ধরে চলছে সূদানের দারফোরের সমস্যা। ভারত কাশ্মিরের সমস্যা বিগত ৬০ বছরেও সমাধান করতে পারেনি। অথচ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার যে অভিযোগ সেটির অস্তিত্ব মার্চের ১৯৭০-য়ের মার্চের একমাস আগেও ছিল না। এমন একটি অভিযোগ পাশ্ববর্তী মায়ানমারে দেড় দশক ধরে চলছে। সেদেশের নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী অং সাঙ সূচীর হাতে সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তাকে গৃহবন্দী করে রেখেছে। কিন্তু তার জন্য কি দেশে গৃহযুদ্ধ নেমে এসেছে? বরং ভারত সে দেশের সামরিক জান্তার সাথে সদ্ভাব বজায় রেখেছে এবং পুরাদস্তুর বাণিজ্যও চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভারত ও তার দোসররা নির্বাচন পরবর্তী সে সমস্যার সমাধানে পাকিস্তানকে আদৌ সময় দিতে রাজী ছিল না। সেটিকে বাহানা বানিয়ে দেশটির বিনাশে হাত দেয়। এটি ছিল অন্যদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে অতিশয় ন্যাক্কারজনক ঘটনা।

দেশ বাঁচলেই দেশের রাজনীতি বাঁচে। একাত্তরে ইস্যু ছিল চিহ্নিত শত্রুর হামলা থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশটিকে বাঁচানোর দায়বদ্ধতা। তখন এমন দায়ব্ধতা থেকেই নিজ নিজ সামর্থ নিয়ে প্রাণপনে ময়দানে নেমে আসে হাজার হাজার আত্মত্যাগী তরুন। এরাই পাকিস্তানের ইতিহাসে রাজাকার। তাদের অধিকাংশই ছিল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বহু হাজার ছিল মাদ্রাসার ছাত্র। অনেকে ছিল পাকিস্তানের অখন্ডতায় বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সমর্থক। বাংলার হাজার বছরের মুসলিম ইতিহাসে বাংলাভাষী মানুষ একটি মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় এভাবে কাফের বাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে সে ইতিহাস খুব একটা নেই। বরং ক্লাইভের ইংরেজ বাহিনী যখন বাংলা দখল করে নেয় তখন বাংলার কোন তরুন একটি তীরও ছুড়েনি। কেউ প্রাণ দিয়েছে সে নজিরও নেই। তিতুমীরের প্রতিরোধ এসেছে অনেক পরে। একাত্তরের বহু হাজার রাজাকার প্রাণ হারিয়েছে। অনেকে পঙ্গু হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার –এ দুই পক্ষের মাঝে সবচেয়ে বেশী প্রাণ হারিয়েছে এবং নির্যাতীত হয়েছে এই রাজাকারেরা। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর যা কিছু হয়েছে তা হয়েছে লড়াইয়ের মাত্র ৯ মাস যুদ্ধ চলাকালে। কিন্তু রাজকারদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলেছে একাত্তরের পরও। বরং তাদের উপর লাগাতর হামলা হচ্ছে বিগত ৩৮ বছর ধরে। বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা ও ইতিহাসের বইয়ে রাজাকারদের বিরুদ্ধে শুধু গালিগালাজই নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কিন্তু তারাও যে একটি চেতনা ও দর্শনের অধিকারি ছিল, বাংলার মুসলমানদের কল্যাণে তাদেরও যে একটি রাজনৈতিক কৌশল বা স্ট্রাটেজী ছিল -সে সত্যটিকে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। রাজাকারদেরও অধিকার দিওয়া হয়নি তাদের চেতনা ও দর্শনের কথাগুলো লোক-সম্মুখে তুলে ধরার। অথচ সেটিও বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ।

রাজাকারের দর্শন
রাজাকারের চেতনার মূল বৈশিষ্ট প্যান-ইসলামিজম বা বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব। যার মূল কথা ভাষা, বর্ণ, ভৌগলিক সীমারেখার উর্দ্ধে উঠে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ চিন্তায় কাজ করা। ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি তাদের বিবেচনাতেই আসেনি। কোনরূপ গুরুত্বই পায়নি। তাদের কাছে যেটি গুরুত্ব পেয়েছিল সেটি হল ভাষা ও অঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠে মুসলিম উম্মাহর শক্তিবৃদ্ধিতে কাজ করা। তারা এটিকে ফরজ দায়িত্ব রূপে ভেবেছে। তাদের সামনে আদর্শ শেখ মুজিব ছিল না, ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম যাদের শতকরা ৬০ ভাগ রক্ত ব্যয় করেছেন ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী উম্মাহ গড়ায়, নিছক নামায-রোযা-হজ্ব-যাকাত পালনে নয়। ভাষার নামে যুদ্ধ করা ইসলামে ফরজ নয়, নবীজীর সূন্নতও নয়। একাজে প্রাণ দিলে শহীদ হওয়ারও সম্ভাবনাও নাই। তাই নবীজী (সাঃ)র কোন সাহাবী ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজে প্রাণ দান দূরে থাক, সামান্য শ্রম, সময় বা অর্থ দান করেছেন সে প্রমাণ নেই। ভিন্ন ভিন্ন ভাষার নামে মুসলমানদের বহু রাষ্ট্র হয়েছে। কিন্তু তাতে শুধু পরাধীনতা, অপমান আর পরাজয়ই বেড়েছে। গৌরব বা স্বাধীনতা বাড়েনি। ফলে ইসলামী চেতনায় বিশ্বাসী হওয়ার কারণে ভাষা ও ভূগোলের ক্ষুদ্রতা ছেড়ে উর্দ্ধে উঠার বিষয়টি রাজাকারের চেতনায় অতি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। ১৯৪৭-য়ে এমন একটি দর্শনের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান। আর দর্শন তো অমর। ফলে সে দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি দেশ মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে প্রয়োজন ফুরিয়ে ফেলবে, সেটি কি কোন মুসলমান মেনে নিতে পারে? ফলে সেটি ইসলামে অঙ্গিকারশূণ্য কম্যিউনিষ্ট, নাস্তিক, বাঙালীবাদী রাজনীতিবিদ, বিদেশের দালাল ও সেকুলারগণ মেনে নিলেও কোন ধর্মপ্রাণ রাজাকার মেনে নিতে পারেনি। মুক্তিযু্দ্ধের চেতনাধারিদের থেকে রাজাকারদের মূল পার্থক্য বস্তুতঃ এখানেই।

বিশ্বে হিন্দুদের বেশী রাষ্ট্র নেই। রাষ্ট্র মাত্র দু’টি। অথচ জনসংখ্যাতে তারা শতকোটি। বাংলার মত প্রায় এক ডজন ভাষা রয়েছে ভারতে। সে ভাষাগুলি নিয়ে ভারতে বাংলাদেশের মত ১০টি বাংলাদেশ নির্মিত হতে পারতো। অথচ তেমন ধারণা তাদের মাথায় ঢুকেনি। ১৯৪৭-য়ে যেমন নয়, আজও নয়। মাত্র একটি রাষ্ট্র গড়ার কারণেই তারা আজ বিশ্বশক্তি হওয়ার পথে। মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু কোরআন পড়তে শেখা নয়, নিছক নামাজ-রোযা পালনও নয়। বরং সেটি ভাষা-বর্ণ-ভৌগলিকতার উর্ধ্বে উঠে অন্য ভাষা, অন্যবর্ণের মুসলমানদের সাথে একাত্ব হয়ে মুসলিম উম্মাহ গড়ার সামর্থ। বিজয় আসে এরূপ একতার পথেই। এমন একতা প্রতিষ্ঠার হুকুম এসেছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। ফলে নামায-রোযা পালনের ন্যায় একতার লক্ষ্যে কাজ করাও ইসলামে ফরজ। বাঙ্গালী মুসলমানদের বড় ব্যর্থতা শুধু এ নয় যে, বিশ্বের ৬শত কোটি মানুষের সবাইকে ছাড়িয়ে দুর্বৃত্তিতে তারা বিশ্বে পাঁচ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বরং বড় ব্যর্থতা হল, অন্যভাষার মুসলমানদেরকে তারা আপন রূপে গ্রহন করতে পারেনি এবং সেটি চরম আকার ধারণ করে একাত্তরে। একতা গড়া কাফেরদের ধর্মীয় দায়িত্ব নয়। অথচ মুসলমানদের উপর একতা গড়া ফরজ। মুসলমান হওয়ার অর্থই হলো কসমোপলিটান হওয়া, তথা নানা ভাষাভাষী মানুষদের নিয়ে সমাজ গড়া। অথচ তারা ইতিহাস গড়েছে Xenophobia তথা ভিন্ন ভাষার মানুষের প্রতি ঘৃণাবোধে। ফলে ভারতের হিন্দুরা যেরূপ ভাষার উর্দ্ধে উঠে ভারতব্যাপী একতা গড়তে পেরেছে বাঙ্গালী মুসলমানরা তা পারেনি। তাই বাংলাদেশে আজও নিগৃহীত হচ্ছে কয়েক লাখ বিহারী। দুরাবস্থায় পড়েছে বার্মা থেকে প্রাণ বাচাতে আসা রোহিঙ্গারা। অথচ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ইতিহাস গড়েছিল রাজাকারেরা। প্যান-ইসলামী চেতনায় পরিপুষ্ট হওয়ার কারণে পাঞ্জাবী, বিহারী, পাঠান, সিন্ধি মুসলমানগণ তাদের কাছে শত্রু মনে হয়নি। বরং তাদেরকে তারা ভাই হিসাবে গ্রহণ করেছে। তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাকে তারা ঈমানী দায়িত্ব ভেবেছে। এবং পাকিস্তান ভাঙ্গার যে কোন উদ্যোগকে তারা হারাম মনে করেছে। সেটি শুধু কিশোরগঞ্জের প্রখ্যাত আলেম জনাব আতাহার আলীর একার ঘোষণা ছিল না। ছিল প্রতিটি রাজাকারের। এলক্ষ্যে প্রাণদানকে তারা শাহাদত মনে করতো। অপর দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ইসলামের প্রতি এমন অঙ্গিকার চিত্রিত হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতা রূপে। তাদের চেতনায় গুরুত্ব পেয়েছিল ভাষাভিত্তিক বাংলাদেশ নির্মাণের বিষয়টি এবং আদর্শ রূপে প্রাধান্য পেয়েছিল ভাষাভিত্তিক জাতিয়তাবাদ, সেকুলারিজম ও সমাজতন্ত্র। ফলে গুরুত্ব পেয়েছিল ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের ক্ষতি সাধনে ইসলামের শত্রুদের সাথে কোয়ালিশন গড়াটিও। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ভারতীয় হিন্দু নেতা ইন্দিরা গান্ধী, শিখ জেনারেল অরোরা, পারসিক জেনারেল মানেক শ’, ইহুদী জেনারেল জ্যাকব অতিশয় আপনজন মনে হয়েছে। এবং তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এমনকি নিজ দেশ ও নিজ ভাষার মুসলিম হত্যাটিও বীর-সুলভ মনে হয়েছে। হাজার হাজার নিরস্ত্র রাজাকারকে হত্যা করা হয়েছে তো এমন এক চেতনাতেই এবং আজও তেমন একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে।

তবে এমন ভাষাভিত্তিক সেকুলার ধারণাটির জন্ম নিছক একাত্তরে হয়নি। এমন চেতনার প্রবল উপস্থিতি ১৯৪৭য়েও ছিল। সেময় সেটির ধারক ছিলেন আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও চল্লিশের দশকে বেঙ্গল মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা জনাব হোসেন শহীদ সহরোওয়ার্দী ও আবুল হাশিম। তারা বাংলা ভাষাকে কেন্দ্রকরে একটি ভাষাভিত্তিক সেকুলার নেশন স্টেটের প্রস্তাব রেখেছিল। তাদের সে প্রস্তাব তৎকালীন বেঙ্গল কংগ্রেসের নেতা শরৎ বোস (সুভাষ বোসের ভাই) এবং কিরন সরকার রায়ের সমর্থন পেলেও কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতা গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেলের সমর্থন পায়নি। সমর্থন পায়নি মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের থেকেও। তবে তার সুস্পষ্ট কারণও ছিল। কারণ ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের ধারণা মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস কারো কাছেই নীতিগত ভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না। ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের ধারণাটি ছিল নিছক ইউরোপীয়। তেমন একটি ধারণা ভারতে তখনও বাজার পায়নি। এমনকি যে বাংলা ভাষা নিয়ে এমন একটি চিন্তা শুরু হয়েছিল সেখানেও ভাষা ভিত্তিক রাষ্ট্রের কোন অতীত ঐতিহ্য ছিল না। মোঘল সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলিবর্দী খান বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে যে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল তার ভিত্তি কোন ভাষা ছিল না। এমন কি বাংলায় মুসলিম বিজয়ের পূর্বে সেন রাজাদের শাসনামলেও রাষ্ট্রের ভিত্তি বাংলা ভাষা বা অন্যকোন ভাষা ছিল না। সেন রাজারা এসেছিল দক্ষিণ ভারতের কর্নাটাকা থেকে। তাই স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা কংগ্রেসের কাছে অভিনব মনে হয়েছিল। তাছাড়া এমন ধারণা প্রশ্রয় পেলে কংগ্রেসের অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার ধারণাটিই আস্তাকুঁড়ে গিয়ে পড়তো। তারা তো তখন স্বপ্ন দেখতো পেশোয়ার থেকে বার্মার পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার। তারা স্বপ্ন দেখছিল হিন্দু ভারতকে বিশ্বশক্তি রূপে দাঁড় করানোর। এজন্যই ১৯৩৫ সালে বৃটিশ সরকার যখন ভারত শাসন আইনে সংস্কার এনে বার্মাকে ভারত থেকে আলাদা করে দেয়, কংগ্রেস নেতৃবিন্দু তাতে খুশি হতে পারেননি। তীব্র ভাষায় তারা ব্রিটিশ সরকারের এ সিদ্ধান্তকে নিন্দা করেছিলেন। তাছাড়া ভাষার উপর ভিত্তি করে স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা মেনে নিলে তেলেগু, মালয়লাম, কানাড়া, পাঞ্জাবী ভাষা ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী উঠতো। ফলে কংগ্রেস নেতৃবিন্দু তেমন স্বাধীন রাষ্ট্রের নির্মাণে বাধা দিবে সেটি সহজেই বোধগম্য ছিল। অপর দিকে মুসলিম লীগের পাকিস্তান রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিই ছিল দ্বিজাতি তত্ত্ব ও প্যান-ইসলামিক চেতনা। ভাষাভিত্তিক স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের দাবী মেনে নিলে পাকিস্তান দাবীর আর কোন ভিত্তিই থাকে না। ভিত্তি থাকে না ভারত-বিভক্তিরও। হিন্দুরা যেমন বিশ্বশক্তি রূপে আবির্ভাবের স্বপ্ন দেখতো তেমনি এক বিশাল স্বপ্ন দেখতো সে সময়ের পাকিস্তানপন্থি রাজাকারেরাও। সে সময় তেমন একটি স্বপ্ন নিয়েই তারা রাজপথে রাজনৈতিক লড়াই শুরু করেছিলেন। তখন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদীদের সে দাবীর প্রচন্ড বিরোধীতা হয়েছিল মুসলিম লীগের পত্রিকা দৈনিক আজাদ ও ইংরেজী সাপ্তাহিক কমরেড পত্রিকার তরুণ বুদ্বিজীবীদের পক্ষ থেকে। ফলে সে পরিকল্পনা সেদিন বিজয়ী হতে পারেনি।

কেন এত রক্ত ঝরলো?
কিন্তু কোন একটি চেতনা পরাজিত হলেও তার মৃত্যু ঘটে না। তাই সাতচল্লিশে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনাটি পরাজিত হলেও তা বেঁচেছিল। কায়েদে আজমের মৃত্যূর পর সহরোওয়ার্দী ভারত ছেড়ে পাকিস্তান চলে আসেন। তখন তার চারপাশে ১৯৪৭য়ের বাঙ্গালীবাদীরা জড় হয়। শুরু হয় ভারতের সাথে ষড়যন্ত্রও। সেটি মুজিব ১৯৭১য়ের ৯ই জানুয়ারি পাকিস্তানের জেল থেকে ফিরে সহরোওয়ার্দ্দী উদ্দানে জনসভাতে বলেছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, “বাংলাদেশ নির্মাণে কাজ একাত্তরে নয়, সাতচল্লিশ থেকে শুরু করেছিলাম।” ১৯৭১য়ে সে প্রোজেক্ট বিজয়ী হয়েছিল মাত্র। ফলে মুজিবের কথার মধ্যে ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তান ভাঙ্গার অবিরাম ষড়যন্ত্রেরই সত্যতা মেলে। তাই পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে ইয়াহিয়া খানের সামরিক এ্যাকশনের কারণে – একথা যারা বলেন তারা সত্য বলেন না। তবে বলা যায়, পাকিস্তান সরকার সমুহের পুনঃ পুনঃ রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা শত্রুদের সুযোগ করে দেয়।

মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ একটি দলের ছিল না, ছিল একটি চেতনার প্রতিনিধি। তারা ছিল প্রধানত আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কম্যিউনিষ্ট পার্টির কর্মী ও এসব দলের ছাত্রসংগঠনেরর সদস্যরা। ছিল বহু নির্দলীয় ব্যক্তিও। একই ভাবে রাজাকারেরা কোন একটি বিশেষ দলের ছিল না। তারা ছিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামি, পিডিপি, নেজামে ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও অন্যান্য ইসলামি দলের কর্মী ও তাদের ছাত্রসংগঠনের সদস্যরা। রাজাকারদের দলেও ছিল বহু নির্দলীয় ব্যক্তি। ছিল বহু পীরের মুরীদ। তাদের কাছে পাকিস্তান ছিল স্বপ্নের দেশ। অন্য যে কোন দেশের ন্যায় সে দেশটিতে অনেক সমস্যা ছিল, কিন্তু তারা সে সমস্যার সমাধানে আশাবাদীও ছিল। কিন্তু যে সমস্যাটি সবচেয়ে জটিল ছিল এবং যার সমাধান পাকিস্তানের হাতে ছিল না তা হল বৈদেশিক। সেটি যেমন অর্থনৈতিক ছিল না, তেমনি রাজনৈতিকও ছিল না। তা হলো পাকিস্তানকে মেনে নেয়ায় ভারতের অসম্মতি। ভারতের সে আজন্ম শত্রুতাই পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলছিল। অনেকে বলেন, পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার মূল কারণ, নির্বাচিনে বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা। যারা একথা বলেন তারা সেটি বলেন উপমহাদেশের রাজনীতির নিয়ে নিরেট অজ্ঞতা থেকে। তারা ভূলে যান, একাত্তরের ১৬ই মার্চ থেকে ২২ মার্চ অবধি একটি রাজনৈতিক আপোষের লক্ষ্যে শেখ মুজিবের সাথে ইয়াহিয়া খানের আলোচনার বিষয়টি। ভূলে যান, শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী, ভূট্টোকে উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পরারাষ্ট্রমন্ত্রী করে ইয়াহিয়া একটি আপোষ ফর্মুলা দেন সেটিও। (সূত্রঃ অখন্ড পাকিস্তানের শেষ দিনগুলী, জি. ডব্লিও চৌধুরী, ১৯৭৪) ইয়াহিয়া খানের এ প্রস্তাবের কথা আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাকও এক সাক্ষাতকারে বলেছেন। কিন্তু শেখ মুজিব ক্ষমতা হস্তান্তরের সে প্রস্তাবটিকেও নাচক করে দেন। তিনি দাবী করলেন, পূর্ব পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা তার হাতে হস্তান্তর করতে। এর অর্থ, পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করে পূর্বাংশের শাসনক্ষমতাকে তার হাতে তুলে দিতে হবে। শেখ মুজিব তার নিজের ৬ দফাকেও আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেন। ফলে ষড়যন্ত্র করে শেখ মুজিবকে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি সেটিও নিরেট মিথ্যা তা কি প্রমাণের অপেক্ষা রাখে? মুজিবের লক্ষ্য ছিল, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া নয় বরং বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হওয়া। সে জন্যই তিনি পাকিস্তান ভাঙ্গাকে জরুরী মনে করেন।

কোন দেশের সেনাবাহিনী কি নিজ দেশের বিভক্তিকরণের এমন দাবীকে মেনে নিতে পারে? পার্বত্য চট্টগ্রামের নির্বাচিত উপজাতীয় নেতারা যদি শেখ মুজিবের মত বলে, “আমরা এ অঞ্চলের নির্বাচিত প্রতিনিধি, অতএব পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বময় ক্ষমতা আমাদের হাতে হস্তান্তর করতে হবে” তবে কি বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সে দাবীর মুখে আনন্দে ডুগডুগী বাজাবে? তাছাড়া মুজিব নির্বাচিত হয়েছিলেন পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে। পাকিস্তান ভাঙ্গার সে দাবী নিয়ে তিনি কোনরূপ গণরায় বা রেফারেন্ডাম নেননি। নির্বাচনী কোন জনসভায় সে কথা তিনি মুখেও আনেননি। তেমন একটি রেফারেন্ডামের প্রস্তাব শেষ দিকে ইয়াহিয়া খানও রেখেছিলেন। তিনি প্রস্তাব রেখেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যদি সত্যসত্যই আলাদা হতে চায় তবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার সেটি মেনে নিবে। তবে এজন্য শুধু্ এ বিষয়টির উপর একটি রেফারেন্ডাম হতে হবে। ইয়াহিয়া খানের সে প্রস্তাব নিয়ে পাকিস্তানে নবনিযুক্ত তৎকালীন ভারতীয় দূত জয় কুমার অটাল ত্বড়িৎ দিল্লি যান। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধি সে প্রস্তাব মানেননি। (সূত্রঃ অখন্ড পাকিস্তানের শেষ দিনগুলী, জি. ডব্লিও চৌধুরী, ১৯৭৪) তখন বাংলাদেশের রাজনীতির সিন্ধান্ত এমনকি আওয়ামী লীগের হাতিও থাকেনি। তখন সেটি শেখ মুজিবের মূল পৃষ্ঠপোষক ভারতের হাতে চলে যায়। ইয়াহিয়া খানের সে প্রস্তাবে ইন্দিরা গান্ধি বলেছিলেন, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ই হল সে রিফারন্ডাম। তার দাবী ছিল, পাকিস্তান সরকারকে সে রেফারেন্ডাম মেনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিতে হবে। অথচ কথাটি সত্য ছিল না। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনেই বিভিন্ন বিশেষ ইস্যু থাকে। সত্তরের নির্বাচনেও ছিল। ১৯৭০য়ের নির্বাচনটি হয়েছিল পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র তৈরী ও সে শাসনতন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনকে নিশ্চিত করার বিষয়টি সামনে রেখে। নির্বাচন হয়েছিল পাকিস্তান সরকারের দেওয়া লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক মেনে নিয়ে। সেখানে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার শর্ত ছিল পাকিস্তানের অখন্ডতায় অঙ্গিকারবদ্ধ হওয়া। আওয়ামী লীগ সেটি মেনে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়। দলটির নির্বাচনী ইশতেহারের কোথাও পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করে পৃথক বাংলাদেশে নির্মাণের সামান্যতম উল্লেখ ছিলনা। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগকে পাকিস্তানের দাবীতে নির্বাচন জিততে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দাবীতে আওয়ামী লীগ কোন নির্বাচন জিতেনি। বরং সত্তরের নির্বাচনী জনসভাগুলোতে শেখ মুজিব পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়েছেন। অতএব ইন্দিরা গান্ধি কি করে বলেন, সত্তরের নির্বাচনই ছিল সে রেফারেন্ডাম। এটি কি ম্যাকিয়াভিলিয়ান নীতিহীনতা নয়? আর মুক্তিযুদ্ধের মূল ভিত্তি ছিল এমন এক নীতিহীনতা।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুঝতে হলে অপরিহার্য হল, ভারতের হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিপালনের বিষয়টিকে জানা। ভারতীয় লেখক মি. অশোক রায়নার লিখিত ‘Inside R.A.W’ বইটি যারা পড়েছেন তাদের কাছে এবিষয়টি অজানা থাকার কথা নয়, ভারতীয় গুপ্তচরেরা একাত্তরের বহু আগে থেকেই পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে লিপ্ত ছিল। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা কিভাবে ভারতীয় সামরিক অফিসারদের থেকে প্রশিক্ষণ ও সামরিক সহয়তা পেয়েছে বইটিতে সে বিবরণও এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে তাই ভারতের প্রতি নিমকহালালীর বিষয়টি অনিবার্য ভাবেই এসে যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একাত্তরের সেক্টর কমান্ডারদের এত ভারতপ্রীতির মূল কারণ তো এখানেই। এরাই টিপাই মুখ বাঁধ নির্মিত হলে সুরমা-কুশিয়ারায় পানি থৈ থৈ করবে সে গল্প শোনায়। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে সে বাণীও শোনায়। এমন এক অভিন্ন চেতনাতেই শেখ মুজিব সীমান্ত বাণিজ্যের নামে সীমান্ত খুলে দেন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীরর বহু হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ভারতের হাতে তুলে দেন। অথচ সে অস্ত্র ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অর্থে কেনা। প্রশ্ন হল, শেখ মুজিব যে পরিমাণ অস্ত্র ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন সে পরিমাণ অস্ত্র কি বাংলাদেশ আজও কিনতে পেরেছে? মুজিব তো তার চার বছরের শাসনামলে একখানি ট্যাংক, একখানি বিমান, এমন কি একখানি কামানও কিনতে পারেননি। এভাবে তিনি অরক্ষিত করেছিলেন বাংলাদেশের সীমান্ত ও সার্বভৌমত্ব। প্রতিরক্ষা এভাবে অরক্ষিত হলে কি সে দেশের স্বাধীনতা থাকে? কথা হল, স্বাধীনতার চেতনা বলতে শেখ মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিরা কি এর চেয়ে বেশী কিছু বুঝতেন?

মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে রাজাকারদের আরেকটি বড় পার্থক্য হল, রাজাকারদের জন্ম তাদের নিজ মাতৃভূমিতে, মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায় কোন চিহ্নিত কাফের দেশে নয়। কোন কাফের সরকারের পয়সা ও প্রশিক্ষণেও নয়। ফলে কোন কাফের দেশের প্রতি নিমক হালালীর বিষয়টি রাজাকারের চেতনা রাজ্যে স্থান পায়নি। বরং তারা যে চেতনারটিরই উত্তরসূরী সেটিই ১৯৪৭ সালে তাদের মাতৃভূমিকে আজাদী দিয়েছিল। রাজাকার হওয়ার অর্থ, ইসলামী চেতনার অনুসারি হওয়া এবং মুসলিম স্বার্থের প্রতি অঙ্গিকারবদ্ধ হওয়া। এমন অভিন্ন চেতনার রাজাকারেরাই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল। রাজাকারের চেতনার মূল বৈশিষ্ট, নিজ ভাষা ও নিজ ভৌগলিক পরিচয়ের উর্দ্ধে উঠে অন্য ভাষা ও অন্য অঞ্চলের মুসলমানদের সাথে একাত্ম হওয়ার সামর্থ। এ সামর্থ প্রবলভাবে দেখা গিয়েছিল নবীজীর সাহাবী কেরামের মাঝে। সেখানে আরবের আবু বকর (রাঃ), উমর (রাঃ), আলী (রাঃ) একাত্ম হতে পেরেছিলেন আফ্রিকার বেলাল (রাঃ), ইরানের সালমান ফারসী (রাঃ) ও রোমের শোয়ায়েব (রাঃ)দের সাথে। ১৯৪৭য়ে সে চেতনাটিই পরিচর্যা পেয়েছিল ভারতবর্ষে। ফলে করাচীর জিন্নাহ, বাংলার নাযিমুদ্দিন, উত্তর প্রদেশের লিয়াকত আলী খান্ ও সীমান্ত প্রদেশের আব্দুল কাউয়ুম খান তখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একত্রে কাজ করার সার্মথ পেয়েছিলেন। ফলে বিজয় এসেছিল। বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র পাকিস্তান নির্মিত হয়েছিল তো তেমন একতার বলেই। নইলে পাকিস্তান নির্মাণ দূরে থাক, বাংলাদেশের মত একটি ছোট্ট দেশের প্রতিষ্ঠাও কি সে সময় সম্ভব হত? বাংলার পশ্চাদপদ মুসলমানদের পক্ষ্যে কি একাকী সম্ভব হতো স্বাধীনতা অর্জন?

সোনার বাংলার কিসসা
বাংলার মুসলমানদের উপর গোলামীর জোয়াল একটি ছিল না, ছিল দু’টি। একটি ইংরেজদের, অপরটি হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের। ভারতের অন্য কোন প্রদেশের মুসলমানদের পশ্চাতপদতা এতটা বিশাল ছিল না। তখন বাংলার কয়জন মুসলমানের ভিটায় দালান ছিল? ক’জনের জমিদারি ছিল? ক’জনের ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকুরি ছিল? ক’জনের ঘরে চেয়ার-টেবিল-খাট-পালং দূরে থাক, কাঠের একখানি দরজা ছিল? ক’টি পরিবারে এক জোড়া জুতা ছিল? পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ৪ বছর আগে ১৯৪৩ সালে প্রায় ২০ লাখ মানুষ দূর্ভিক্ষে মারা যায়। বন্যা, খড়া, জলোচ্ছ্বাস, ম্যালেরিয়া ও কলেরা ফি বছর লেগেই থাকতো। পাঞ্জাব, সিন্ধ, সীমান্ত প্রদেশে অবস্থা তেমনটি ছিল না। পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশে ব্রিটিশদের গো্লামী থাকলেও হিন্দু জমিদারদের গোলামী ছিল না। সে সব প্রদেশে বরং মুসলমান জমিদারদের সংখ্যাই ছিল বেশী। লাহোর, করাচী, পাটনা, এলাহাবাদে যত জন মুসলিম উকিল-মোক্তার, ডাক্তার, শিক্ষক ছিল তা ঢাকাতে ছিল না। কোলকাতাতেও ছিল না। ফলে ঐসব অঞ্চলে অমুসলমানদের তুলনায় মুসলমানদের মাঝে এতটা পশ্চাদপদতা ছিল না। পাকিস্তানের গুরুত্ব বুঝাতে মুসলিম লীগকে তাই সেসব প্রদেশে প্রচন্ড বাধা পেতে হয়েছে। অথচ অতি পশ্চাতপদতার কারণেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন অনুভব করে বাংলার মুসলমানেরা। অথচ আওয়ামী লীগের কল্পনায় সে অধঃপতিত বাংলাটিই ছিল সোনার বাংলা। আওয়ামী লীগের অভিযোগ, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার সে সোনার বাংলাটিকে শ্মশান বানিয়েছে। সত্তরের নির্বাচনের আগে “সোনার বাংলা শ্মশান কেন?” নামে একটি পোষ্টার ছাপে। শ্মশান করার দায়ভার চাপিয়েছিল পাকিস্তান সরকারের উপর। কথা হল সোনার বাংলার মানুষেরা শত শত বছর ধরে যে সব সোনার ঘরে বাস করতেন তার কোন চিত্র কি বাংলাদেশের কোথাও মেলে? কথা হল, ক্ষমতার লোভে মানুষকে কি এতটা মিথ্যাচারে নামতে হবে?

শেখ মুজিব ও তার দলের নেতাদের মগজে তখন যে চেতনাটি বাসা বেঁধেছিল সেটি হল ম্যাকিয়াভিলিয়ান নীতি। এ নীতির মূল কথা, ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতিতে যে কোন মিথ্যা ও প্রচারণাই জায়েজ। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে দেশের দক্ষিণের উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে প্রলয়ংকরি জলোচ্ছ্বাস হয়। তাতে আনুমানিক ৫ লাখ মানুষ মারা যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের সেকুলার মেডিয়াগুলো সে জলোচ্ছ্বাসের দায়ভার চাপিয়েছিল পাকিস্তানে সরকারের্ উপর, জলোচ্ছ্বাসের উপর ততটা নয়। তখন দূর্দশাগ্রস্ত মানুষের মাঝে পুনর্বাসনের কাজের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ডিসেম্বরে ছিল নির্বাচন। পাকিস্তান সরকার হিমসীম খাচ্ছিল নির্বাচনের আয়োজন নিয়ে। চাচ্ছিল নির্বাচন কিছুদিনে জন্য পিছিয়ে পুনর্বাসনের কাজ করতে। কিন্তু ক্ষমতা-পাগল আওয়ামী লীগ নির্বাচন একদিন পিছাতেও রাজী ছিল না। যে কোন বিলম্বের তারস্বরে বিরোধীতা করেছিল। সে পুনর্বাসনের কাজে পাকিস্তান সরকার সে সময় বিদেশ থেকেও তেমন সাহায্য পায়নি। ফলে রিলিফের কাজে দুরাবস্থা ছিল। জলোচ্ছ্বাসের ফলে সৃষ্ট দুর্দশাকে নির্বাচনী প্রচারে তথা রাজনীতির কাজে লাগাতে ভূল করেনি আওয়ামী লীগ। বলা যায় সত্তরের নির্বাচেন তাদের এমন অভূতপূর্ব সাফল্যের বড় কারণ ছিল, বাংলাদেশের জ্বলোচ্ছ্বাস রাজনৈতিক ব্যবহার। ভাষা, বর্ণ বা অঞ্চল-ভিত্তিক জাতিয়তাবাদী চেতনার প্রকোপে আওয়ামী নেতা-কর্মীগণ এতটাই আক্রান্ত ছিল যে, একাধিক ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চল নিয়ে গড়া পাকিস্তানের প্রতি তাদের সামান্যতম দরদও ছিল না। এমন এক ক্ষুদ্র স্বার্থ-চেতনা ব্যক্তি থেকে একতার সামর্থই কেড়ে নেয়। তখন তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের লক্ষে কাজ করা। সে সামর্থ বিলুপ্ত হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা থেকে। অথচ মুসলমান হওয়ার অর্থই হল, ঈমান ও ইবাদতের পাশাপাশি মুসলমানদের মাঝে একতা প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হওয়া। নামায-রোযা যতই পালিত হোক, অন্য ভাষার অন্য দেশের মুসলমানদের সাথে একাত্ম হওয়ার সামর্থ্য অর্জিত না হলে তাকে কি মুসলমান বলা যায়? মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ চিন্তা ও একতার প্রতি অঙ্গিকার আসে আল্লাহর প্রতি ঈমান ও কোরআনী জ্ঞান থেকে। সেকুলারিজমে সেটি হয় না। পৌত্তলিক কাফের শক্তির প্রতি অনুরাগেও সে চেতনাটি বাঁচে না। তাই নামে মুসলমান হলেও সেকুলার চেতনার ধারক হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ নেতাদের মাঝে যেমন সে ঐক্যচেতনাটি ছিল না, তেমনি সেটি ছিল না ভারতে প্রতিপালিত মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝেও। পাকিস্তানকে ব্যর্থ করে দেওয়ার যে কাজ ভারত ১৯৪৭ থেকে শুরু করেছিল সে মুসলিম শক্তিবিনাশী মিশনে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সেকুলার শক্তিও যোগ দেয়।

বিচ্ছিন্নতার পরিকল্পনা ছিল পূর্ব-পরিকল্পিত

মুসলমানেরা আজ যে ভাবে বিশ্বব্যাপী বিভক্ত ও শক্তিহীন, তা এরূপ জাতিয়তাবাদী চেতনার কারণেই। আওয়ামী লীগ নেতাদের মাঝে এ চেতনাটি বাসা বেধেছিল বহু আগেই। মুসলিম উম্মাহর শক্তিবৃদ্ধি ও ইসলামের গৌরবের বিষয়টি আদৌ তাদের রাজনীতির বিষয় ছিল না। ফলে সামান্যতম দরদও ছিল না অখন্ড পাকিস্তানের প্রতি। একারণেই সত্তরের নির্বাচনে পশ্চিম-পাকিস্তানে গিয়ে নির্বাচনী প্রচারে শেখ মুজিব সামান্যতম আগ্রহও দেখায়নি। কোন রূপ শক্তি বা সময়ও ব্যয় করেনি। অথচ তার দলটিই ছিল পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ দল। আর একটি দেশের সর্ব বৃহৎ রাজনৈতিক দলের আচরণ দেশটির সাথে যদি এমন হয় তবে সে দেশটি কি বাঁচে? তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে রাজনীতি সম্প্রসারণের বিষয়টি যে ১৯৭০য়ে গুরুত্ব হারিয়েছিল তা নয়, একই চেতনা প্রবল ছিল দলটির প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই। পাকিস্তানের শক্তিবৃদ্ধি ও দেশটির সমস্যাবলীর সমাধানে বাংলাদেশের মুসলমানদের দায়িত্ব ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের চেয়েও অধিক। কারণ তারা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু সে বিশাল দায়িত্ব আওয়ামী লীগের ন্যায় একটি আঞ্চলিক দলের দ্বারা পালিত হয়নি। কারণ সেটির জন্য সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির উর্ধ্বে উঠতে হয়, অথচ সে সামর্থ আওয়ামী লীগ নেতাদের ছিল না। ফলে পাকিস্তানের ব্যর্থতা নিয়ে কি শুধু পশ্চিম পাকিস্তানীদের দায়ী করা যায়?

শেখ মুজিবের বিচ্ছিন্নতার পরিকল্পনা ছিল পুর্ব-পরিকল্পিত। তার দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে নিছক পাকিস্তান সরকার ও জনগণকে ধোকা দেওয়ার প্রয়োজনে। সমগ্র পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ে তার সামান্যতম আগ্রহও ছিল না। শেখ মুজিবের আসল মনযোগ ছিল, যে কোন প্রকারে সত্তরের নির্বাচনে পূর্ব-পাকিস্তানে বিজয়ী হওয়া। সে বিজয়ের সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার দাবী তোলার জন্য একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করা। এটির প্রমাণ মেলে নির্বাচনের পর। বিজয়ী হওয়ার সাথে সাথে তিনি তার রাজনীতির সুর পাল্টিয়েছেন। পাকিস্তান ভেঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা তার হাতে দেওয়ার দাবি তুলেছেন। ফলে যে উদ্দশ্যে সত্তরের নির্বাচন হযেছিল সেটি মুজিবের ক্ষমতালাভের লোভে সহসাই হ্যাইজাক হয়ে যায়। পরিকল্পিত শাসনতন্ত্র রচনার দায়িত্ব ভূলে আওয়ামী লীগ তার সমগ্র সামর্থ্য নিয়োগ করে পাকিস্তানের মানচিত্র খাওয়ায়। এভাবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নয়, ভারতীয় গোয়ান্দা বাহিনীর পরিকল্পনা মোতাবেক শেখ মুজিব নিজেই রক্তাক্ষয়ী এক যুদ্ধকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর চাপিয়ে দেন। এ লক্ষ্যে ২৫শে মার্চের বহু আগেই আওয়ামী লীগের কর্মীরা বাংলাদেশের বহু স্থানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ছিল তেমনি একটি অস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। কাঠের বন্দুক নিয়ে সেখানে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্রদের সামরিক প্রশিক্ষণ চলতো। তা নিয়ে গর্বভরে বইও লেখা হয়েছে। বাংলাদেশের মাটি রক্তাত্ব হয় মূলতঃ শেখ মুজিবের এমন একটি গোপন ষড়যন্ত্রের কারণে। বাংলাদেশের মানুষের সাথে এটি ছিল এক প্রচন্ড প্রতারণা। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে ভোট নিয়ে তিনি যেমন একদলীয় শাসন চাপিয়ে দেন, তেমনি পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচিত হয়ে একটি যুদ্ধ এবং সে যুদ্ধের সাথে আগ্রাসী ভারতীয় বাহিনীর দখলদারীও প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতের মাটিতে ও ভারতীয় অর্থ ও নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্ম হয় এমন একটি যুদ্ধে দ্রুত বিজয় আনার লক্ষ্যে। তাই যারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের জন্ম হয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালিত যুদ্ধ, রক্তপাত ও জুলুমকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে সেটি মিথ্যা। বরং ভারত্ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পাকিস্তানের জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়। ভারতের এমন আগ্রাসী ষড়যন্ত্র নিয়ে রাজাকারদের মনে সামান্যতম সন্দেহ ছিল না। এমন একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি ভারত ১৯৪৭ সাল থেকেই শুরু করেছিল। সেটি যেমন শেখ মুজিব জানতেন। জানতেন সহরোওয়ার্দ্দি ও আবুল মনসূর আহমদের মত আওয়ামী লীগ নেতারাও।

যে কারণে যুদ্ধ শুরু হল

শেখ মুজিব দাবি তোলেন শুধু পূর্ব পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা তার হাতে তুলে দেবার। অথচ ইয়াহিয়ার প্রস্তাব ছিল ভূট্টোকে উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী করে শেখ মুজিব সমগ্র পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা হাতে নিক। কিন্তু তাতে তিনি রাজী হননি। জেনারেল ইয়াহিয়া খান মুজিবের দাবীর কাছে তিনি নতি স্বীকার করেননি। আর তখনই শুরু হয় যুদ্ধ। আর এমন একটি যুদ্ধের জন্য ভারত মুজিবের অনুসারিদের পূর্ব থেকেই প্রস্তুত রেখেছিল। অথচ একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধটি সহজেই পরিহার করা যেত। কিন্তু মুসলমানদের শত্রুপক্ষের সেটি কাম্য ছিল না। তারা চাচ্ছিল মুসলমানদের মাঝে ভাতৃঘাতি একটি ভয়ানক যুদ্ধ শুরু হোক। রক্তের গভীরে ডুবে যাক সাত চল্লিশের প্যান-ইসলামি চেতনা এবং চিরস্থায়ী হোক বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী মুসলমানদের মাঝে তিক্ততাটি । আর সেটি বুঝা যায়, একাত্তরের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরই শেখ মুজিব ঘোষণা দেন তিরিশ লাখ বাঙ্গালী হত্যার কথা। এ মিথ্যা তথ্যটি বলা হয়েছে নিছক বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী মুসলমানদের সম্পর্কটাকে রশাতলে ডুবানোর স্বার্থে। ভারতকে খুশি করার এর চেয়ে বড় কাজ আর কি হতে পারে? ভারত তো সেটিই চাইতো। ভিয়েতনামে যুদ্ধ চলেছে ১২ বছর ধরে। সেখানে ১২ বছরে নিহত হয়েছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। অথচ সেখানে নাপাম বোমা, ক্লাস্টার বোমাসহ নানান ধরণের বহু হাজার বোমা ফেলা হয়েছে বার বছর ধরে। এর পরও প্রতি বছর যা মারা গেছে তা গড়ে ৮৩ হাজারের বেশী নয়। অথচ বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে ৯ মাসেই মারা গেছে ৩০ লাখ! অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১১ হাজারেরও বেশী! হ্টিলারের অনেকগুলো গ্যাস চেম্বার ছিল। কিন্তু তারপরও প্রতিদিন মানুষ হত্যার গড় হার এর চেয়ে অনেক কম ছিল। অর্থাৎ শেখ মুজিব তিরিশ লাখের তথ্য শুনিয়েছিলেন পাকিস্তান আর্মিকে হিটলারের বাহিনী থেকেও বর্বর রূপে চিত্রিত করার লক্ষ্যে। অথচ মজার ব্যাপার হলো যাদের কে তিনি এমন জঘন্য খুনি রূপে চিত্রিত করলেন তাদের একজনে বিরুদ্ধেও কোন রূপ অভিযোগ খাড়া করতে পারেননি। প্রমাণের অভাবে নিজ দেশে বা আন্তর্জাতিক আদালতে এ নিয়ে কোন মামলাও দায়ের করতে পারেননি। ফলে পাকিস্তানী সেনাসদস্যদের বিনা বিচারে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। শত শত মানুষকে নিয়োগ করে আজও তেমন প্রমাণ খাড়া করতে পারছে না শেখ হাসিনার সরকার।

শেখ মুজিব এবং সে সাথে আওয়ামী রাজনীতির মূল লক্ষ্য হল ক্ষমতা লাভ, এবং সে লক্ষ্যেই প্রয়োজন ছিল প্রকান্ড প্রপাগান্ডার। সে প্রপাগান্ডার সার্থেই প্রয়োজন পড়েছিল বিশাল আকারের মিথ্যা রটনার। মেকিয়াভেলিয়ান নীতিবিদদের রাজনীতি তো বেঁচে থাকে এমন মিথ্যার উপরই। মুজিব মারা গেছেন। তবে তার রচিত সে মিথ্যার মৃত্যু ঘটেনি। তার দলীয় নেতা-কর্মীরা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিরা আজও তিরিশ লাখের সে মিথ্যা কথাটি বাঁচিয়ে রেখেছে এবং সেটিই বিরাম বলে বেড়াচ্ছেন। এখন এ মিথ্যাটিতে বিশ্বাসী হওয়া মু্ক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হওয়ার অপরিহার্য শর্ত। কালেমা না পড়লে যেমন মুসলমান হওয়া যায় না তেমনি এ তিরিশ লাখের মিথ্যা তথ্যে বিশ্বাসী না হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিও হওয়া যায় না।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় ষড়যন্ত্রের কথা রাজাকারদের কাছে অজানা ছিল না। ফলে তাদের পক্ষে পাকিস্তানের সে দূর্দীনে নীরব বা নিষ্ক্রীয় থাকাটি অস্বাভাবিক ছিল। অবশ্য অনেক সুযোগ সন্ধানীও জুটেছিল। প্রতি সমাজে এমন লোকের সংখ্যাও প্রচুর যাদের নিজেদের কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ্য থাকে না। তারা ভেসে চলে জনতার স্রোতে। আর বাংলাদেশের মত দেশে এমন স্রোতে ভাসা মানুষের সংখ্যা অনেক বেশী। এরা যেমন রাজাকার হয়েছে তেমনি মুক্তিবাহিনীও হয়েছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর এসব রাজাকারেরা আবার বিজয়ী পক্ষের সাথে দলে ভিড়ে যায়। এদের অনেকেই আজ রাজাকারদের পরাজয়ের দিনগুলোকে বিজয়ের উৎসবরূপে পালন করে। এ উৎসব পালনে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আজ রাজপথেও নামছে।

কোন মুসলিম দেশে বিবাদ থাকাটি অস্বাভাবিক নয়। এমন বিবাদ সাহাবীদের সময়ও ছিল। কিন্তু অস্বাভাবিক হল, এবং সে সাথে অভাবনীয় হল, সে বিবাদকে বাহানা করে একটি কাফের শক্তিকে নিজ দেশে আহ্বান করা বা কাফের দেশে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করা। এব্যাপারে মহান আল্লাহর সুস্পষ্ট সতর্কবাণী হল,
“ঈমানদারগণ যেন ঈমানদারদের ছেড়ে কোন কাফেরদের বন্ধু রূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না।” -(সুরা আল ইমরান, আয়াত ২৮)
এ আয়াতটির মূল কথা হল, কাফেরদের সাথে সম্পর্ক গড়ার অর্থ আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের অধিকাংশ মুসলিম নামধারী হলেও তাদের কাছে আল্লাহর এ ঘোষণা আদৌ গুরুত্ব পায়নি। তাই তারা কাফের ইন্দিরার কাছে ধর্না দিয়েছে। আর তার ফল দাড়িয়েছে এই, ভারত সরকারের সাথে বন্ধুত্বের মাঝেই শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের সম্পর্ক সীমিত থাকেনি। বিজয় লাভের পরপরই আওয়ামী লীগ কোরআনের শিক্ষা বা ইসলামী চেতনাকে সাম্প্রদায়ীক বলে সেটির বিনাশে নেমেছে। অবস্থান নিয়েছে ইসলামের প্রতিপক্ষ হয়ে। কোরআনের বাণী “আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না” – এ সত্যটিকেই তারা প্রবল ভাবে প্রমাণিত করেছে এবং আবির্ভূত হয়েছে শয়তানের স্বপক্ষ রূপে।

রাজাকারগণ সংখ্যায় বেশী ছিল না। তাদের সামনে ছিল প্রবল প্রতিপক্ষ। প্রতিপক্ষ শুধু মুক্তিযোদ্ধারাই ছিল না, ছিল বিশাল ভারত ও বিশাল রাশিয়া। তারা জানতো বিজয় লাভ এতটা সহজ নয়। কিন্তু প্রবল প্রতিপক্ষের ভয়ে নীরব ও নিষ্ক্রীয় হয়ে যাওয়া কি মুসলমানের সাজে? পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছেঃ “তোমাদের প্রস্তুতি হালকা হোক বা ভারি হোক বেরিয়ে পড় এবং জিহাদ কর আল্লাহর রাস্তায় তোমাদের জান ও মাল দিয়ে। এটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর যদি তোমরা বুঝতে পারতে।” -(সুরা তাওবাহ, আয়াত ৪১) পাকিস্তান বাঁচানোর কাজকে তার জ্বিহাদ গণ্য করেছে। ১৯৪৭ ছিল ভারতীয় মুসলমানদের বিজয়ের দিন। সে বিজয় এসেছিল একতার বলে। মুসলমানদের একতার ভিত্তি ভাষা নয়, বর্ণও নয়। সেটি হল কোরআন। আল্লাহর রাসূল এ কোরআনকেই বলেছেন আল্লাহর রশি। ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চলের দোহাই বন্ধন গড়ার অর্থ আল্লাহর সে রশি থেকে মুসলমানদের সরিয়ে নেওয়া। ইসলামে এটি হারাম। একারণেই আরব, ইরানী, তুর্কী, কুর্দীসহ নানা নানা ভাষাভাষী মানুষ শত শত বছর একত্রে একই ভূগোলে বাস করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ একত্রে বসবাসের সে অভ্যাস পাকিস্তানে চালু রাখতে দেয়নি। পাকিস্তানের জীবনে ২৩টি বছরও পূর্ণ হতে দেয়নি। এমন বিভক্তি শুধু পরাজয়ই আনে না, সত্যপথ থেকে চরম বিচ্যুতিও আনে। আনে বিশাল আযাব। হেদায়েত পাওয়ার অপরিহার্য শর্ত হল, মুসলমানদের আল্লাহর নির্দেশাবলীকে ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, কোরআনের ভাষায় তারাই পথভ্রষ্ট হয়ে গেল এবং আযাব ডেকে আনলো। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণাটি হলঃ “তোমরা আল্লাহর রশিকে সুদৃঢ় হস্তে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” –(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৩) “এবং যে ব্যক্তিই আল্লাহকে তথা কোরআনে বর্ণীত আল্লাহর নির্দেশাবলীকে আঁকড়ে ধরলো সেই সরল পথের দিকে হেদায়েত পেল।– (সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০১) “তোমরা তাদের মত হয়োনা যারা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসার পরও পরস্পরে বিভক্তি গড়লো এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, এবং তারাই হল সে সব ব্যক্তি যাদের জন্য রয়েছে বিরাট আযাব।” –(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৫)

যে অবাধ্যতা আযাব ডেকে আনে
বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ ইসলামে হারাম। বিচ্ছিন্নতায় যেটি প্রকাশ পায় সেটি আল্লাহর হুকুমের চরম অবাধ্যতা। বিচ্ছিন্নতার এ পথ সিরাতুল মোস্তাকিম থেকে ছিটকে পড়ার পথ। এপথ বস্তুতঃ নিজেদের ঘাড়ে আল্লাহর আযাব নামিয়ে আনার পথ। তাই সে পথে পা বাড়ায়নি একাত্তরের রাজাকারেরা। পবিত্র কোরআনের নির্দেশ অনুসারে ঈমানদার হওয়ার জন্য অপরিহার্য শর্ত হল আল্লাহর রশিকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরা, ভাষা ও বর্ণের বাঁধনকে নয়। আল্লাহর সে রশিটি হল পবিত্র কোরআন। ভাষা বা ভৌগলিক পরিচয়ের অহংকার নিয়ে বিভক্ত হলে বা বিচ্ছিন্নতাবাদে দীক্ষা নিলে তাতে ঈমান বাঁচে না। এতে প্রচন্ডভাবে যা বাড়ে তা হল পথভ্রষ্টতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীরা রাস্তাঘাটে মূর্তিগড়ে, মোঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে, শরিয়ত প্রতিষ্ঠার প্রাণপনে বিরোধীতা করে, কোরআনের চর্চা না বাড়িয়ে রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা বাড়ায় -তা তো সে পথভ্রষ্টতারই প্রমাণ। এমন পথভ্রষ্টতাই আল্লাহর প্রতিশ্রুত আযাবও নামিয়ে আনে। আনে বিশ্বজোড়া অসম্মান। বাংলাদেশ যেভাবে দূর্নীতিতে বিশ্বে বার বার প্রথম হল, ভিক্ষার ঝুলির খেতাব পেল –তা কি এসব মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিদের অর্জন নয়? মুক্তিযুদ্ধ্বের চেতনাধারীরা কোরআনকে বাদ দিয়ে আঁকড়ে ধরেছিল সেকুলারিজম, জাতিয়তাবাদ, সমাজতন্ত্রের ন্যায় আস্তাকুঁড়ের মতবাদগুলোকে। এদিক দিয়ে ভারতীয় কাফেরদের থেকে তাদের পার্থক্য কোথায়? মুসলমান হওয়ার অর্থ শুধু মুর্তিপুজা থেকে দূরে থাকা নয়, কাফেরদের আদর্শগুলোও পরিত্যাগ করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীরা সেটি পারেনি। তাই বাংলাদেশে যতই বেড়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের সংখ্যা ও বিজয়, ততই বেড়েছে আল্লাহর আযাব। তাই সে আযাব জলোচ্ছ্বাসের বেশে ১৯৭০য়ের নভেম্বরে যেমন এসেছে, সেটি দুর্ভিক্ষের বেশে ১৯৭৪য়েও এসেছে, প্রলয়ের বেশে ১৯৯১তেও এসেছে। এখনও অবিরাম আসছে নানা বেশে। কোদালকে কোদালই বলতে হয়। কাফেরকে কাফের বলা, মোনাফিককে মোনাফিক বলা যেমন আল্লাহর সূন্নত, আযাবকে আযাব বলাও তেমনি সূন্নত। এসব আযাব নিয়ে কাফের বা সেকুলারদের ব্যাখা যাই হোক, সেটি ঈমানদারের ব্যাখা নয়। আল্লাহর অনুমতি ছাড়া গাছের একটি পাতাও পড়ে না। বান্দাহর গায়ে একটি আঁচড়ও লাগে না। ঈমানদারির কথা তো এটিই। কোরআনে সে সত্যটি বার বার বলা হয়েছে। তাই জলোচ্ছ্বাসে লাখ লাখ মানুষ ভাসে কি করে? সে ক্ষমতা কি পানির আছে? পানির সে ক্ষমতাটি তো আসে আল্লাহর হুকুমে। আল্লাহর হুকুমে ক্ষুদ্র মশাও বিশাল বোমার চেয়ে মারাত্মক হতে পারে। ক্ষুদ্র পাথর টুকরা পরিণত হতে পারে মিজাইলে। এমন মিজাইলে মারা পড়েছিল মক্কার উপর আগ্রাসী বাদশাহ আবরাহ’র বিশাল বিশাল হাতি। ক্ষুদ্র মশা গুড়িয়ে দিয়েছিল নমরুদের অহংকার। কোরআনে বর্ণীত আদ-সামুদ জাতি ও মাদায়েনের অধিবাসীর উপর কি এতবড় আযাব এসেছিল যা বার বার আসছে বাংলাদেশে? লক্ষ লক্ষ মানুষ কি সে আযাবে মৃত্যু বরণ করেছিল যা মারা গেছে বাংলাদেশে? আদ-সামুদ জাতি আল্লাহর অবাধ্যতা করেছিল ঠিকই। কিন্তু সে অবাধ্যতায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রটি ধ্বংস হয়নি এবং একটি প্রতিবেশী কাফের দেশও বিশ্বশক্তি হওয়ার সুযোগ পায়নি। তাদের সে অবাধ্যতায় হাজার হাজার মুসলমানের জীবনে মৃত্যু, ধর্ষন, লুন্ঠন, নির্যাতন ও গ্লানিও নামিয়ে আনেনি।

রাজাকারের স্বপ্ন

রাজাকারের চেতনা-রাজ্যের সবটুকু জুড়ে বিরাট স্বপ্ন ছিল বিশ্বশক্তি রূপে মুসলমানের উত্থানের। স্বপ্ন ছিল ইসলামের পূনঃপ্রতিষ্ঠার। দেহে প্রাণ থাকা যেমন জীবনের লক্ষণ, তেমনি এমন স্বপ্ন থাকাটাও ঈমানের লক্ষণ। আর প্রকৃত ঈমানদারের শুধু এ স্বপ্নটুকুই থাকে না, সে স্বপ্নের বাস্তাবায়নে প্রাণপন প্রচেষ্টাও থাকে। এজন্যই তো ঈমানদার মাত্রই রাজাকার তথা স্বেচ্ছাচারি সৈনিক। এমন রাজাকার যেমন নবীজীর সাহাবাগণ ছিলেন, তেমনি প্রতিযুগের মোজাহিদগণও ছিলেন। ছিলেন তারাও যারা সাতচল্লিশে “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” ধ্বণিতে কংগ্রেস ও হিন্দুমহাসভার গুন্ডাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। তাই যারা ১৯৭১য়ে ভারতীয় বাহিনী ও তার গৃহপালিত দাসদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন তারাই মুসলিম বিশ্বের একমাত্র রাজকার নন। এমন রাজাকার আজও অসংখ্য। এরাই আজ আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ের্ স্বপ্ন দেখে। ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আজও তারা প্রতিরোধে নামে। এ সত্যটুকু বুঝতে শয়তান ভূল করে না। ভূল করে না শয়তানী শক্তির বাংলাদেশী সেবাদাসেরাও। তাই বাংলাদেশের রাজপথে যখন দাড়িটুপিধারীদের রাজাকার বলে লগি-বৈঠা নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাতে বিস্ময়ের কিছু থাকে না। বিস্ময় তখনও জাগে না যখন একাত্তরের পরে জন্ম নেওয়া ইসলামী চেতনাধারী যুবককে রাজাকার বলে হত্যা করা হয়। এবং বিস্ময় জাগে না, যখন একাত্তরে যুদ্ধে অংশ নেয়নি আশি বছরের এক বৃদ্ধ আলেমকে রাজাকার বলা হয় এবং তাকে হত্যা করা হয। রাজাকারের সংজ্ঞা নিয়ে বর্ণচোরা মুসলমান বা বেওকুফদের সংশয় থাকতে পারে, কিন্তু সে সংশয় শয়তানের নেই। তাই রাজাকার চিনতে সে ভূল করে না। এজন্যই মাদ্রাসা-মসজিদ গুলোকে শয়তানী শক্তির এজেন্টরা যখন রাজাকার উৎপাদনের কারখানা বলে তখন তারা ভূল বলে না। কারণ এগুলোই তো আল্লাহর ইনস্টিটিউশন। তাই এখান থেকে রাজাকারের বদলে কি ইসলামে অঙ্গিকারহীন মুক্তিযোদ্ধা পয়দা হবে?

মুসলমানের বিজয় ও ইসলামের প্রতিষ্ঠা নিছক তেলের খনি, গ্যাসের খনি, পাটের চাষ, পোষাক উৎপাদন বা গরু-মহিষের আবাদ বাড়িয়ে সম্ভব নয়। মুসলিম বিশ্বে কি সেগুলি কম বেড়েছে? কিন্তু তাতে অপমান, পরাজয় ও গ্লানি ছাড়া আর কোনটি বেড়েছে? বিজয়ের জন্য অপরিহার্য হল বিশাল একখানি ভূগোল, জনগণের অটুট একতা ও কোরআনের শিক্ষার প্রতি দৃঢ় অঙ্গিকারবদ্ধতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহীরা এ তিনটিকেই হত্যা করেছে। এবং সেকাজে ভারতের ন্যায় শত্রু থেকে পেয়েছে বিপুল অর্থ, অস্ত্র ও পরামর্শ। সেটি যেমন একাত্তরে পেয়েছে, তেমনি এখনও পাচ্ছে। ইসলাম ও বাংলাদেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে এটিই তাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ। আর এ অপরাধ কর্মের জন্যই ভারতের কাফের শাসকেরাই শুধু নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইলসহ ইসলামের তাবত শত্রুপক্ষ তাদের উপর এতটা প্রসন্ন। আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিস্তিনে ইসরাইল এবং কাশ্মিরে ভারত তো এ কাজগুলোই নিজেরা করছে। আর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীরা যদি তাদের সে কাঙ্খিত কাজটি নিজেরা সমাধা করে দেয় তবে তো আনন্দে তারা ডুগডুগিই বাজাবে। আর বাংলাদেশে তো এজন্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিদের নির্বাচনী বিজয়ে দিল্লি, ওয়াশিংটন, তেলআবিবে আনন্দের হিল্লোল বইতে শুরু করে।

জয় বাংলা নয়, আল্লাহু আকবর

তবে একাত্তরের রাজাকারদের উপর জুলুম শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিদের দ্বারাই হয়নি। হচ্ছে তাদের দ্বারাও যারা একাত্তরে রাজাকার ছিল এবং ইসলামী সংগঠনের নেতা রূপে রাজাকার বাহিনীকে সংগঠিত করেছিল। একাত্তরের পরাজয় এসব তথাকথিত নেতাদের মনবলই ভেঙ্গে দিয়েছে। এখন তারা নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচানোর ফিকিরে ব্যস্ত। ইসলামী চেতনা, শরিয়তের প্রতিষ্ঠা, রাজাকারের ত্যাগের ইতিহাস -এসব নিয়ে তাদের আর ভাবার সময় নেই। নিজেদের প্রতিষ্ঠা বাড়াতে এখন মার্কিন মুল্লুক ও মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরাচারিদের দরবারে ধর্ণা দেওয়াকে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে। যুগে যুগে এমন পরাজিতরাই বিজয়ীদের দলে ভিড়ে তাদের বিজয়-উৎসবকে নিজেদের উৎসব রূপে পালন করে। এমন পরাজিত চেতনার কারণেই ক্লাইভের বিজয়ী বাহিনী যখন মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করেছিল তখন সে বাহিনীকে দেখতে এলাকার হাজার হাজার মানুষ হাজির হয়েছিল। এমন পরাজিত চেতনা নিয়েই রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ সম্রাটের ভারত আগমন উপলক্ষ্যে তার সম্মানে কবিতা লিখেছেন এবং স্যার উপাধিও পেয়েছেন। এমন এক পরাজিত চেতনার কারণেই একাত্তরের রাজাকার নেতাদের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়েছে সরলমনা সেসব অসংখ্য যুবকদের নিষ্পাপ নিরীহ চেহারা যারা নিছক ঈমানের তাড়নায় সেদিন ভারতীয় ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় পিতামাতার ঘর বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার হোস্টেল ছেড়ে রণাঙ্গনে নেমে এসেছিল। অনেকের পিতামাতাই সেদিন নিজের রাজাকার সন্তানদের লাশও দেখতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিরা হাত-পা বাধা অবস্থায় তাদের দেহে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শুধু হত্যাই করেনি, লাশকেও বিকৃত করেছে। বহু ঘটনা এমনও ঘটেছে, হত্যার আগে তাদের দেহে জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে জ্বালানো হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের কালেমা “জয়বাংলা” বলতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশের মুসলমানদের স্লোগান সব সময় নারায়ে তকবীর আল্লাহু আকবর ছিল। মুসলমানের দায়িত্ব হল কাজ ও কথার মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহ যে সর্বশ্রেষ্ঠ সেটিরই ঘোষণা দেওয়া। দেশ, ভাষা, বর্ণ বা রাজা-বাদশাহকে নয়। জয়োধ্বনি দিতে হলে দেশ, ভাষা, বর্ণের স্রষ্টা মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে দিতে হবে, সৃষ্টিকে নয়। সে নির্দেশটিই দেওয়া হয়েছে পবিত্র কোরআনে। “নারায়ে তকবীর, আল্লাহু আকবর” -তাই নিছক রাজনৈতিক স্লোগান নয়। এটিই মুসলমানের ঈমানের প্রতিধ্বনি। ঈমানের সে প্রতিধ্বনি জয় বাংলায় প্রকাশ পায় না। “জয়বাংলা” স্লোগানে যেটি প্রকাশ পায় সেটি হল একটি ভূগোলকে বিজয়ী করার চেতনা, একাত্তরের প্রেক্ষাপটে তা ছিল একটি মুসলিম দেশের খন্ডিত বা দূর্বল করার চেতনা। কথা হলো, একজন মুসলমান এমন কথা কেন বলবে যার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় ভূগোল-ভিত্তিক অহংকার এবং একটি মুসলিম দেশের ক্ষতির অঙ্গিকার। এটি তো হারাম। তাই কোন রাজাকার সেদিন জয় বাংলা স্লোগান দেয়নি। অবর্ণনীয় কষ্ট সয়ে তারা বরং কালেমায়ে শাহাদত পাঠ করেছেন। এবং কালেমায়ে শাহাদত পাঠ করতে করতে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের কাছে তাদের কবরটুকুও সেদিন প্রাপ্য মনে হয়নি। কুকুর-শৃগাল দিয়ে তাদের অনেকের লাশ খাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, কখনও বা বিকৃত লাশকে নদীতে ফেলা হয়েছে বা মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। একই আচরণ হয়েছে অবাঙ্গালীদের সাথে। সে নৃশংস হত্যা ও নির্যাতন নিয়ে ওরিয়ানা ফালাসীর মত প্রখ্যাত বিদেশী সাংবাদিকেরা বহু পৃষ্ঠা লিখছেন। বিদেশী পত্র-পত্রিকায় সে সব বীভৎস ঘটনার ছবি এবং বিবরণ ছাপাও হয়েছে। অথচ এসব ইসলামী দলের বড় বড় নেতারা অর্ধ পৃষ্ঠাও লিখেননি। তবে তারা যে বই লিখেন না তা নয়। কিন্তু তাদের স্মৃতিতে ইসলামের এ বীর সন্তানেরাও যে স্থান পায়নি সে প্রমাণ মেলে তাদের বই পড়লে। এখন এসব নেতারা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বলতে ব্যস্ত। তাদের স্মৃতি স্তম্ভে ফুলের মালা চড়াচ্ছেন, নগ্ন পদে চলছেন। অথচ একাত্তরে তারা নিজেরাই তাদেরকে দুস্কৃতিকারী বলেছেন। কথা হলো, ইসলামে কি এরূপ দু’মুখো নীতি চলে? আর তাতে কি চেতনায় ইসলাম বাঁচে?

মুসলমানের বিশেষ বৈশিষ্ট শুধু এ নয় যে, আল্লাহর রাসূল ও রাসূলের অনুসারিদের তারা প্রচন্ড ভাবে ভালবাসে। ঈমানদারের আরেক অবিচ্ছেদ্দ্য বৈশিষ্ট হল, যারা ইসলামের বিপক্ষ শক্তি এবং ইসলামের ও মুসলমানের যারা ক্ষতি করে তাদেরকে প্রচন্ড ঘৃণা করা। ঈমানদারের গুণাগুণ বলতে গিয়ে পবিত্র কোরআন বলেছে, “আশাদ্দু আলাল কুফ্ফার” এবং “রুহামাও বায়নাহুম” –অর্থাৎ আল্লাহর অবাধ্য তথা কাফেরদের বিরুদ্ধে তারা অতিশয় কঠোর আর নিজেদের মধ্যে তারা পরস্পরে বড়ই রহমদিল বা আন্তরিক। ভাল মানুষ ও দুর্বৃত্তদের ভালবাসার কাজ একসাথে চলে না। এ বিষয়ে নবীজী (সাঃ)র হাদীস, “গুনাহ বা ক্ষতিকর কাজ হতে দেখলে ঈমানদারের দায়িত্ব হল সে কাজ শক্তি বলে রুখা। শক্তি না থাকলে মুখের কথা দিয়ে প্রতিবাদ করা। আর সেটিও না থাকলে মন থেকে সেটিকে ঘৃণা করা। আর এ ঘৃণাটুকুও না থাকলে বুঝতে হবে, তার অন্তরে শরিষার দানা পরিমান ঈমানও নেই”। একটি মুসলিম দেশকে খন্ডিত করার চেয়ে জঘন্য খারাপ কাজ আর কি হতে পারে? মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় ক্ষতিকর কাজই বা আর কি হতে পারে? দেশের ভূগোলের উপর হামলা রুখতে সাহাবায়ে কেরাম জ্বিহাদ করেছেন, দলে দলে শহীদ হয়েছেন। মুসলিম উম্মাহর অপুরণীয় ক্ষতি করতেই আরব বিশ্বকে খন্ডিত করেছে মুসলিম-দুষমন পাশ্চাত্যের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। অখন্ড ভূগোলকে ভেঙ্গে বাইশ টুকরায় বিভক্ত করেছে। আরবদের এভাবে দূর্বল ও নির্জীব করার পরই প্রতিষ্ঠা করেছে ইসরাইল। দেশ খন্ডিত হওয়ার পর যে দূর্বলতা বাড়ে সেটি কি মাথাপিছু আয়ু বাড়িয়ে দূর করা যায়? কুয়েত, আবুধাবি, কাতার সৌদি আরবের মাথাপিছু আয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও অধিক। কিন্তু তাতে কি শক্তি বেড়েছে? বেড়েছে কি প্রতিরক্ষার সামর্থ্য। তাই কোন শত্রুপক্ষ যখন কোন দেশবাসীকে দূর্বল করতে চায় তখন তারা সে দেশটির মানচিত্রে হাত দেয়। ভারত সেটি করেছিল পাকিস্তানের বিরদ্ধে। তাই কোন ঈমানদার কি কাফের শক্তির হাতে মুসলিম উম্মাহর দেহ এভাবে টুকরো টুকরো হতে দেখে খুশি হতে পারে? খুশি হলে তার মনে শরিষার দানা পরিমাণ ঈমান আছে সেটিও কি বিশ্বাস করা যায়? এমন বিধ্বংসী কাজে একমাত্র শয়তান এবং শয়তানের অনুসারীরাই খুশি হতে পারে। কোন ঈমানদার নয়। আফ্রিকার সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র সূদানকে আজ খন্ডিত করার কাজ চলছে। সেটিকে মুসলমানেরা নিজেদের রক্ত দিয়ে রুখছে। একই ষড়যন্ত্র চলছে ইরাক ও তুরস্কের বিরুদ্ধে। কোন মুসলমান কি সূদান, ইরাক, তুরস্ক বা অন্যকোন মুসলিম দেশের খন্ডিত করার সাম্রাজ্যবাদী চেষ্টায় খুশি হতে পারে? অথচ মুসলিম পরিচয়ধারি হয়েও শেখ মুজিব এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিরা একাত্তরে তো সে কাজটিই করেছে। তারা শুধু বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশটিকেই ধ্বংস করেনি, পৌত্তলিকদের ন্যায় মূ্র্তি বসিয়েছে পথেঘাটে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে এবং কোরআনের আয়াত খসিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে। ক্ষমতার মসনদে বসে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে কি হবে, প্রথমে ইসলামের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করেছে এবং অসম্ভব করেছে আল্লাহর আইন তথা শরিয়তের প্রতিষ্ঠা। অথচ বহু কাফের দেশেও মুসলমানদের উপর এরূপ নিষেধাজ্ঞা নেই। মুজিব একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছে এবং পদদলিত করেছে মৌলিক নাগরিক অধিকার। অথচ গণতন্ত্র-বিরোধী, নূন্যতম মানবিক-অধিকার বিরোধী এ ব্যক্তিটিই হলেন মুক্তিযোদ্ধদের আদর্শ পুরুষ!

যে মিশনের মৃত্যূ নেই

প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব হল, যেকোন মুসলিম দেশে বিচ্ছিন্নতার প্রতিটি উদ্যোগকে শক্তি বলে রুখা। সেটি যেমন আজকের বাংলাদেশে প্রযোজ্য, তেমনি প্রযোজ্য ছিল একাত্তরের পাকিস্তানেও। কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমানেরা শুধু পতিতাবৃত্তি, সূদী ব্যংক, ব্রিটিশের প্রণীত হারাম আইনকেই বরণ করে নেয়নি, শ্রদ্ধাভরে বরণ করে নিয়েছে এসব হারাম কাজের নেতাদেরকেও। দিয়েছে বন্ধুর (বঙ্গবন্ধুর) খেতাব। আজও বিপুল ভোটে নির্বাচিত করে বিভিন্ন দলের দুর্বৃত্ত নেতাদের। অথচ আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং মুসলমানের বন্ধু হতে হলে তো তাকে মুসলমান ও ইসলামেরও বন্ধু হতে হয়। মুসলিম দেশের অখন্ডতার হেফাজতে কাফেরদের বিরুদ্ধেও বীরদর্পে রুখে দাঁড়াতে হয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর তায়ালার ঘোষণা, “হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারি হয়ে যাও।..” আল্লাহর সাহায্যকারি হওয়ার অর্থ শুধু আমিও মুসলমান –এ টুকু বলা নয়। শুধু নামায-রোযা আদায় নয়। আল্লাহপাক তার বান্দাহ থেকে আরো বৃহ্ত্তর কিছু চান। এবং সেটি ইসলামের বিজয় ও মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষায় ব্যক্তির অঙ্গিকার ও কোরবানী। এটিই ছিল রাজাকারের জীবনে মিশন। এ মিশন শ্বাশ্বত। সেটি বিমূর্ত তার রাজনীতি ও যুদ্ধ-বিগ্রহে। মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিরা নামে মুসলমান হলেও আল্লাহর ঘোষিত এ মিশনকে তারা নিজেদের জীবনের মিশন রূপে গ্রহন করেনি। বরং ভারতের মিশন তাদের নিজেদের মিশনে পরিণত হয়। ফলে মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষার জন্য কিছু করার বদলে তারা সেটিকে ধ্বংস করেছেন। এভাবে প্রচন্ড খুশি বাড়িয়েছে তাদের কাফের বন্ধুদের।

মুজিব ও তার অনুসারিদের মুসলিম উম্মাহর শক্তিবিনাশী প্রয়াসকে রুখবার প্রাণপন চেষ্টা করেছে রাজাকারেরা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারি তথা ইসলামের বিপক্ষ শক্তির কাছে রাজাকারদের আজও এটিই বড় অপরাধ। একজন কাফের, নাস্তিক, জঘন্য পাপাচারি বা হিন্দুস্থানী এজেন্ট মুসলিম রাষ্ট্রবিনাশী নেতাকে পরম বন্ধু বলবে সেটিই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তাকে একজন মুসলমানও কি বন্ধু রূপে বরণ করে নিতে পারে? বন্ধু রূপে মেনে নিতে পারে কি কোন ইসলামি সংগঠনের নেতা, কর্মী বা সমর্থক। অথচ বাংলাদেশে সেটিও হচ্ছে। দেশটির ইসলামপন্থি নেতাকর্মীরা নিজেদের পত্র-পত্রিকা, লেখনি ও বক্তৃতা-বিবৃতিতে এমন নেতাকে বঙ্গবন্ধু বলছে এবং শ্রেষ্ঠ সন্তান বলছে মুক্তিযোদ্ধাদের। তাদের সাথে তাদের বিজয়ের দিনগুলোতে মিছিল করছে, উৎসবেও নামছে। দেশটিতে ইসলামি জ্ঞানশূণ্যতা ও চেতনাশূণ্যতা যে কতটা গভীরে পৌছেছে এ হল তার নমুনা। তাই পচন শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের একার নয়, আক্রান্ত হয়েছে তথাকথিত ইসলামী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরাও। গ্রামে কলেরা লাগলে তাতে আস্তিক-নাস্তিক সবাই আক্রন্ত হয়। তেমনি দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক পথভ্রষ্টতার প্লাবন শুরু হলে তাতে শুধু বেঈমানরাই ভাসে না, অনেকেই ভাসে। প্লাবনে যেমন শুধু শিকড়হীন কচুরিপানাই ভাসে না, ভাসে সে সব গাছপালাও যাদের শীকড় মাটির গভীরে যায়নি। বুদ্ধিবৃত্তিক পথভ্রষ্টতার প্লাবন থেকে বাঁচতে হলে ইসলামী জ্ঞানের শিকড় তাই অত্যন্ত গভীরে যাওয়া দরকার। নবীজী (সাঃ)র আমলে অজ্ঞতার সে প্লাবন অতি প্রবল ছিল আরবে। প্লাবনের সে স্রোত থেকে বাঁচানোর তাগিদে নবীজী লাগাতর ১৩টি বছর ধরে মক্কায় ইসলামি জ্ঞানচর্চকে তীব্রতর করেছিলেন। এভাবে গভীরতর করেছেন ইসলামী আক্বীদা ও দর্শনকে। পবিত্র কোরআনের মক্কী সুরাগুলোতে মহান আল্লাহতায়ালা তো এ বিষয়গুলোকেই বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। কাবাকে ঘিরে তখনও উলঙ্গ তাওয়াফ হত, মদ্যপান ও নাচগান হত, সাহিত্যের নামে কবিতা পাঠের আসর বসতো। আরব সংস্কৃতিকে অমর রাখতে মিনাতে তখন ফিবছর উৎসবও হত। কিন্তু সে যুগের নব্য মুসলমানেরা সে সাংস্কৃতিক প্লাবনে ভেসে না গিয়ে নিজেরাই বিপরীত ধারার স্রোত গড়েছেন। এবং সেটি সম্ভব হয়েছিল ইসলামি জ্ঞানের গভীরতায় আল্লাহর দ্বীনের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ার কারণে। কোরআন হল আল্লাহর রশি। আর সে রশিতে তাঁরা নোঙর বেঁধেছিলেন সিরাতুল মোস্তাকিমের সাথে। ফলে তাদের জীবনে পথভ্রষ্টতা আসেনি। অথচ সে বাঁধনটি না থাকায় পথভ্রষ্টতার জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল মদিনার ইহুদীরা। আল্লাহ ও তাঁর নবী হযরত ইব্রাহীম (আঃ), হযরত ইয়াকুব আঃ) ও হযরত মুসা (আঃ)র ন্যায় নবীরাসূলদের উপর বিশ্বাসী হওয়ার দাবীদার হওয়া সত্বেও তারা আল্লাহর সর্বশেষ নবী ও তাঁর অনুসারীদের নির্মূলে মক্কার পৌত্তলিক কাফেরদের সাথে কোয়ালিশন গড়েছিল। জঙ্গে-আহজাব তথা পরিখা যুদ্ধের সময় আরবের সকল কাফের গোত্র যখন একত্রে মদিনার উপর হামলা করেছিল, তখন তারাও সে হামলায় সমর্থন দিয়েছিল। আহলে কিতাবদের সমগ্র ইতিহাসে ইহুদীদের এ কর্ম ছিল যেমন গর্হিত তেমনি ছিল নজির বিহীন।

কেন এ আত্মসমর্পণ?
বাংলাদেশের ইসলামপন্থিদের মাঝে আজ যে এত আত্মসমর্পণ তারও হেতু আছে। দেশটিতে কোরআনী জ্ঞানচর্চার কাজটিই যথার্থ ভাবে হয়নি। কোরআন চর্চার নামে দেশে কোরআন তেলাওয়াত বাড়লেও কোরআন বুঝার আগ্রহ বাড়েনি। ইসলামী দলের নেতারা বই লেখার নামে নিজেদের স্মৃতী কথা লিখেছেন, পরিবারের কিসসাকাহিনী শুনিয়েছেন, কিন্তু ইসলামি দর্শনে হাত দেননি। ফলে একাত্তরের ঘটনাবলির একটি দর্শন-সুলভ বিশ্লেষণ আজও লিখিত হয়নি। অথচ উপমহাদেশের মুসলমানদের হাজার বছরের ইতিহাসে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর আগে আর কখনই কোন মুসলিম ভূমি কোন পৌত্তলিক কাফের শক্তির পদানত হয়নি। পৌত্তলিক কাফেরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটি মুসলিম দেশ ধ্বংসের কাজে মুসলমানেরা অংশ নিয়েছে সে ইতিহাসও নির্মিত হয়নি। ভারতে মুসলিম বিজয়ের পর থেকে আর কখনই উপমহাদেশে হিন্দুদের বিশ্বশক্তিরূপে উত্থানের এরূপ সুযোগও সৃষ্টি হয়নি। এবং কাফেরদের সে আধিপত্য স্থাপনে সহয়তা দিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা। এটা সত্য, একাত্তর নিয়ে যাদের ভাষ্য জোয়ারের পানির ন্যায় দেশটির উপর ছেয়ে আছে সেটি মুক্তিযোদ্ধাদের। তাদের ভাষ্যের বিরুদ্ধে কথা বললে প্রচন্ড গালি-গালাজ শুরু হবে, জীবনের উপর হামলা আসবে সেটিই স্বাভাবিক। তবে প্রশ্ন হল, গালি-গালাজকারি লোকগুলো কারা? কোন ঈমানদার এমন গালি দেয়? এরা তো চিহ্নিত বিপক্ষ শক্তি। ইসলামের প্রয়োগকে এরা বলে সাম্প্রদয়িকতা। ইসলামের বিজয়ের প্রতি অঙ্গিকারকে বলে মৌলবাদ। শরিয়তকে বলা মধ্যযুগীয় বর্বরতা। ইসলামের প্রতিষ্ঠা রুখতে অতীতের ন্যায় তারা নতুন করে কোয়ালিশন গড়ছে বিশ্বের তাবত কাফের শক্তির সাথে। আল্লাহর দ্বীন, তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর আইন যাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি তাদের থেকে স্বীকৃতি পেতে কোন মুসলমান কি আগ্রহী হতে পারে? ঈমানদার কথা বলবে বা বই লিখবে কি এদের মন জুগাতে? না মহান আল্লাহকে খুশি করতে? ইসলামের বিপক্ষ শক্তির গালি-গালাজ খাওয়া তো নবীজীর সূন্নত। এ সূন্নত পালনের পথ বেয়েই তো ফরজ পালন হয় এবং প্রতিষ্ঠা পায় আল্লাহর দ্বীন। গালি খাওয়ার এ সূন্নতে যাদের ভয় এবং ইজ্জত যাবে এ শংকা, তাদের দ্বারা কি জিহাদের ফরজ পালন হয়? অথচ বাংলাদেশের ইসলামপন্থিদগণ বিপক্ষশক্তির মন জুগিয়ে কথা বলাটিকে হিকমত ভাবছে।

আলো ও আঁধারের ন্যায় প্রতিদেশে যেমন সত্য থাকে তেমনি অসত্যও থাকে। থাকে পথভ্রষ্টতার গভীর স্রোত। পথভ্রষ্টতার স্রোতে ভেসে যাওয়া থেকে বাঁচতে হলে চাই ইসলামি জ্ঞানের গভীরতা। শুধু নামায-রোযায় সে বাঁচাটি নিশ্চিত হয় না। ইসলামে নামায-রোযার সাথে জ্ঞানচর্চাকেও তাই ফরজ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সে জ্ঞানচর্চার ফরজ কাজটি যথার্থ ভাবে পালিত হয়নি। ফলে কমেনি পথভ্রষ্টতার স্রোতে ভেসে যাওয়াটি। আর পথভ্রষ্টতার প্রকোপে যেটি বাড়ে সেটি নেক আমল বা সুনীতি নয়, বরং দুর্বৃত্তি। বাংলাদেশে দুর্বৃত্তিতে বার বার যেভাবে বিশ্বে চাম্পিয়ন সেটি তো পথভ্রষ্টতার কারণেই। দেশে কোরআনী জ্ঞান যেমন বাড়েনি, তেমনি গুরুত্ব পায়নি ইসলামী জ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোও। ফলে হিন্দুস্থান ভেঙ্গে ১৯৪৭য়ে কেন পাকিস্তান বানানো হল তার উপর ইসলামপন্থিদের পক্ষ থেকে একখানি বইও লেখা হয়নি। তেমনি একাত্তরে কেন পাকিস্তান বাঁচাতে দল-মত নির্বিশেষে সকল ইসলামপন্থি দল এবং সকল মতের আলেম ময়দানে নামলো তার উপরও কোন বই লেখা হয়নি। দলগুলোর মনযোগ শুধু দলীয় ক্যাডারের সংখ্যাবৃদ্ধি ও ক্যাডারদের আনুগত্যকে কি করে আরো গভীরতর করা যায় সেটিতে। এমন বুদ্ধিবৃত্তিক শূণ্যতা নিয়ে কোন আন্দোলন বাঁচে? তাদের মধ্যে জ্ঞানচর্চায় যেমন আগ্রহ নেই, তেমনি আগ্রহ নেই একতাবদ্ধ মুসলিম উম্মাহ গড়াতেও। বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ না করে ধুম্রজালের মধ্যে রাখা হয়েছে একাত্তরের ঘটনাবলি। আর তা থেকে পুরা ফায়দা নিয়েছে ইসলামের শত্রু-পক্ষ।

বাংলাদেশের ইতিহাস জুড়ে যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্লাবনটি ব্যাপক ভাবে চলছে সেটি জাতিয়তাবাদী সেকুলার চেতনার। জাতিয়তাবাদের আকর্ষণ অতি গভীর। এটি দেয় চরম অহংবোধ। দেয় অন্যদের থেকে নিজেদেরকে বড় ভাবার এক চমক। এ থেকে বাঁচা তাই সহজ ব্যাপার নয়। বাঁচতে হলে চাই ইসলামী জ্ঞানের গভীরতা ও মুসলিম উম্মাহর একতা ও শক্তিবৃদ্ধির লক্ষ্যে গভীর অঙ্গিকার। খোলাফায়ে রাশেদার পর স্বৈরাচারি উমাইয়ারা যে আরব জাতিয়তাবাদের জোয়ার সৃষ্টি করেছিল সে স্রোতে ভেসে গিয়েছিল সে আমলের বহু নামাযী মুসলমানও। আরব জাতিয়তাবাদের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ তখন জন্ম নিয়েছিল ইরানী জাতিয়তাবাদ। সে দ্বন্ধে তখন খন্ডিত হয়ে যায় মুসলিম উম্মাহ এবং সৃষ্টি হয় জাতিয়তাবাদী ইরান। তাই একতা বিধ্বংসী এ রোগটি মুসলিম বিশ্বে এই প্রথম নয়, মহামারি কলেরা-প্লেগের ন্যায় এটি বার বার আবির্ভূত হয়েছে এবং ব্যাপক ক্ষতিও করেছে। বাংলাদেশে আজো সে রোগে আক্রান্ত মুসলমানের সংখ্যা কম নয়। এমন কি সে প্লাবনে ভেসে গেছে ইসলামপন্থি পুরাতনদের সাথে নতুন প্রজন্মও। ফলে পাকিস্তান বাঁচানোর চেষ্টার জন্য একাত্তরের ইসলামপন্থি নেতা-কর্মীগণ নিন্দিত হচ্ছেন নিজ দল ও নিজ গৃহে এবং তাদের নিজ সন্তান ও কর্মীদের কাছে। সে নিন্দাবাদ থেকে বাঁচবার তাগিদে এখন তাদের নিজেদের মাঝেই শুরু হয়েছে “একাত্তরে ভূল করেছি” সে আত্ম-প্রবঞ্চনা এবং তার জন্য মাফ চাওয়ার সুর। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এটি এক বড় বিজয়। একাত্তরে ভারতীয় সেনাবাহিনী সামরিক বিজয় লাভ করলেও এমন আদর্শিক বিজয় পায়নি।

মুসলমানদের পরাজয় ইতিহাসে কম নয়। হাজার হাজার পয়গম্বরও পরাজিত হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন এবং নিহতও হয়েছেন। বহু বার পরাজিত হয়েছেন সাহাবায়ে কেরামগণ। কিন্তু সামরিক পরাজয়ের সাথে তারা কখনও আদর্শিক পরাজয় মেনে নেননি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইসলামপন্থিদের উদাহরণ নজিরহীন। বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা ও পথভ্রষ্টতা এখন তাই শুধু সেকুলারদের একার নয়। সে পথভ্রষ্টতার শিকার এখন ইসলামপন্থিরাও। বাংলাদেশের বহু ইসলামপন্থিরাও এখন আর তাই ইসলামি দৃষ্টিকোন দিয়ে একাত্তরকে দেখে না, দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। এমন কি সৌদি আরবে শত শত ইরানী হাজিকে হত্যা করা হলেও তাদের কাছে সেটি নিন্দনীয় মনে হয় না। এর চেয়ে বড় ভ্রষ্টতা বা ডিগবাজী কি হতে পারে? এমন ডিগবাজীর কারণেই মুজিব ও মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকে তাদের কাছে আজ সঠিক ও গৌরবজনক মনে হয়। আর ভূল মনে হয় তাদের নিজেদের একাত্তরের ভূমিকা।

লাগাতর প্রপান্ডার মাধ্যমে ভূলিয়ে দেওয়া হয়েছে এমন এক দেশের কথা যে দেশে পূর্ব-পাকিস্তানিরা ২০ বছরের বেশী কাল ধরে নিজেদেরকে গর্বিত নাগরিক ভেবেছে। ১৪ আগষ্ট ও ২৩শে মার্চ পালন করেছে, নানা দিবসে বলিষ্ঠ কন্ঠে জিন্দাবাদ ধ্বণিও তুলেছে এবং সে দেশের প্রতিরক্ষায় রাজস্বও জুগিয়েছে। জনতার রোষ থেকে বাঁচা ও ভোট লাভের তাগিদে পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বণি এমনকি শেখ মুজিব ও তার সহকর্মীরাও দিয়েছে। একবার নয়, বহুশত বার। বুদ্ধিবৃত্তিক ভ্রষ্টতা ও দুর্গতি বাংলাদেশে যে কতটা গভীর তারই প্রমাণ মেলে তাই একাত্তরের মূল্যায়নে। আর পথভ্রষ্টতা গভীর না হলে দেশটি দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে পাঁচবার শিরোপাই বা পায় কি করে? চারিত্রিক বিপর্যয় তো বহুদেশে বহু ভাবে আসে, কিন্তু চারিত্রিক পচনে তথা নীচে নামার সে দৌড়ে সবার আগে থাকা কি চাট্টি খানী কথা? পচনটি এক্ষেত্রে সর্বগ্রাসী হওয়া চাই। একটি দেশের জন্য এর চেয়ে বড় বিপর্যয় আর কি হতে পারে? দেশের ইসলামপন্থিগণও সে বুদ্ধিবৃত্তিক বিপর্যয় থেকে কি বাঁচতে পেরেছে?

দেশ কি আরেক সংঘাতের দিকে?
নানা দুঃখের মাঝেও বাংলাদেশীদের সৌভাগ্য হল, একাত্তরের বহু বছর পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের আসল রূপ তারা আবার দেখতে পাচ্ছে। অতীত ইতিহাস থেকে যাদের ছবক হাছিলের যোগ্যতা নেই আল্লাহতায়ালা তাদেরকে এভাবেই বার বার ছবক দিয়ে থাকেন। এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে তাদের নতুন ভাবে সাক্ষাত-পরিচয়টি হচ্ছে। আবার লাগাতর আঘাত হানা শুরু হয়েছে মুসলমানদের স্বাধীন ভাবে বাঁচার সামর্থ-বিনাশে। একাত্তরে ভারতীয় অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সেনা অফিসার ও সেপাহীদের হত্যা করা হয়েছিল। অথচ সে সেনাবাহিনীটিও গড়ে তোলা হয়েছিল বাংলার মানুষের ট্যাক্সের অর্থে। লক্ষ্য ছিল, এ সেনাবাহিনী মুসলমানদেরকে আবার বিশ্বমাঝে মাথা তুলে দাঁড়াবার সামর্থ বাড়াবে। কিন্তু সেটি যেমন ভারতের ন্যায় কাফের শক্তির পছন্দ হয়নি, তেমনি পছন্দ হয়নি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিদের। একই ভাবে আজ ভারতীয়দের খুশি করতে খুন করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা বাংলাদেশের সেনা অফিসার ও সেপাহীদের। ৭১ থেকে ৭৫ অবধি যেভাবে পাটের গুদামে আগুন ও শিল্পকারাখানা ধ্বংস করা হয়েছিল সেটিই আবার শুরু হয়েছে। মুজিবামলে ছাত্ররা লাশ হত ক্যাম্পাসে। শুরু হয়েছে সেটিও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিরা সে আমলে ভারতকে অনুমতি দিয়েছিল ফারাক্কা বাঁধ থেকে পানি তুলে নেয়ায়। আজ সে অনুমতি দেয়া হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে। মুক্তিযোদ্ধাদের যে প্রবল চেতনাটি একাত্তরে সীমান্ত বাণিজ্যের নামে বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দিয়েছিল, এখন সে পথেই এগুচ্ছে ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার নামে। তবে পার্থক্য হল, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিপক্ষ রূপে সে সময় লক্ষাধিক রাজাকারের প্রবল প্রতিরোধ ছিল। ফলে তাদের একার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল বিজয়। তাই সেদিন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ডেকে এনেছিল ভারতীয় সেনা। কিন্তু আজ ভারতীয় বাহিনীর প্রয়োজন পড়ছে না বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকার। তাদের পক্ষে সে কাজটিই অতি কুশলতার সাথে করছে তাদের হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা।

ইতিহাসের সাক্ষ্য হলঃ কাফের শক্তির লাগাতর সাহায্য ও পরিচর্যা ছাড়া মুসলিম স্বার্থ বিনাশী কোন শক্তিই মুসলিম দেশে একাকী বাঁচতে পারে না। বিজয়ীও হতে পারে না। তাই যুগে যুগে মির জাফরেরা সব সময়েই ক্লাইভদের ঘাড়ে ভর করে। আফগানিস্তানের কম্যিউনিস্টরা তাই রুশ বাহিনীকে ডেকে এনেছিল। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সেকুলার শক্তি তাই মার্কিন বাহিনীকে ডেকে আনছে। পঁচাত্তরে বাংলাদেশে তারা ত্বড়িৎ সেটি পায়নি বলেই বাঁচতেও পারেনি। আর আজ তাদের বাঁচাতেই বাংলাদেশে ট্রজানের ঘোড়ার মত প্রবেশ করেছে হাজারে হাজার এনজিও। বিশ্বের তাবত ইসলাম-বিনাশী শক্তি এ কাজে একতাবদ্ধ। ভারতও গোঁফে তা দিচ্ছে এবং সেটিই প্রকাশ পেয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখার্জীর বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, এবার আওয়ামী লীগ সরকারের উপর কিছু হলে ভারত বসে থাকবে না। একাত্তরে ইন্দিরাও একই কথা বলেছিল এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসাতে যুদ্ধ শুরু করেছিল। একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরে এটি হল শক্তিশালী প্রতিবেশীর পক্ষ থেকে উলঙ্গ হস্তক্ষেপের হুমকি। আর এমন একটি হস্তক্ষেপের দাওয়াত দিতে আওয়ামী লীগ যেমন একাত্তরে পিছপা হয়নি, তেমন আগামীতেও হবে না। এভাবেই নিছক রাজনৈতিক ক্ষমতালিপ্সার কারণে তারা আবার রক্তাত্ব করবে বাংলাদেশের মাটি। তাদের একার পক্ষে বিজয় অর্জন ও সেটি ধরে রাখা দিন দিন অসম্ভব হয়ে উঠছে। ফলে দ্রুততার সাথে এ পক্ষটি ভারতের করুণা নির্ভরও হচ্ছে। দূর্বল দেশের স্থিতিশীলতা তো এভাবেই বিনষ্ট হয়। এভাবেই তো শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘাত। দূর্বল দেশকে এভাবে দূর্বল রাখার এটিই তো সাম্রাজ্যবাদীদের সনাতন কৌশল। বাংলাদেশ আজ সেটিরই শিকার। একাত্তরে রাজাকারেরা নিজেদের রক্ত ঢেলে সে আগ্রাসনের বিরোধীতা করেছিল। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শত্রুতা এজন্যই রাজাকারদের বিরুদ্ধে এতটা গভীর। রাজাকারদের বিরুদ্ধে আজ যে লাগাতর প্রপাগান্ডা সে কাজে এজন্যই বিপুল অর্থ আসছে ভারত থেকে। অন্যান্য কাজকর্ম ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীরা আজ যেভাবে রাজকারদের বিরুদ্ধে এত শ্রম, এত সময় ও এত অর্থ ব্যয় করছে সেটির মূল রহস্য তো এটিই। বাংলাদেশের প্রতি ভারত সরকারের এটাই তো মূল প্রায়োরিটি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীরা অন্য কাজে যেমন অর্থ পায় না, তেমনি আগ্রহও পায় না। অপরদিকে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রবল চেতনাটিই হল রাজাকারের চেতনা। তাই যতই বাড়বে এ চেতনা ততই বলবান হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

  1. Mash’Allah your article is very unique and well-argued. You have done a great job in presenting the truth of our history. It is a shame that nobody has really made any effort to write about this topic with an open mind. We are badly missing the other side of this story of so-called Independence. People are scared to tell the truth. However, as a Muslim we are commanded to be just and truthful in every situation. No matter how hard and dangerous it may be , we as Muslim have to be intellectually honest. That’s where we Bangladeshis are failing very badly. The new generation of Bangladesh are growing up with a very distorted view of 1971 and the process how this country earned it’s so-called independence. I thank you from bottom of my heart to embark upon such a great journey to speak the truth and to wake people from utter delusion. May Allah swt help us all to understand the importance of (real) history and take lesson from it.

Leave a Reply to Umm Aalia Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>